- সারাদেশ
- ১২ কলেজের ৫ কোটি টাকা লোপাট
১২ কলেজের ৫ কোটি টাকা লোপাট

একটি-দুটি নয়, একসঙ্গে চারটি কলেজের অধ্যক্ষ আবুল হাসান মো. আশরাফুদৌলা রুবেল। সবশেষ জেলা পরিষদ নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বগুড়ায় সরকারি স্বীকৃতিবিহীন ১২টি টেকনিক্যাল কলেজের বিভিন্ন পদে নিয়োগের নামে রুবেলের বিরুদ্ধে ৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীরা একাধিক মামলা করলেও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মজিবুর রহমান মজনুর ছত্রছায়ায় তিনি দুর্নীতির ডালপালা বিস্তার করেই চলেছেন। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হতে বসেছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে রুবেল সমকালকে জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে নিয়মের বাইরে তিনি কিছুই করেননি। সরকারি অনুমোদন প্রাপ্ত ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে এসব কলেজে নিয়োগ হয়। বোর্ডের সেক্রেটারি হিসেবে তাঁর পক্ষে নিয়োগ বাণিজ্যের কোনো সুযোগ নেই। একটি মহল বিশেষ উদ্দেশ্যে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। এমপিওভুক্ত হলে তিনটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদ ছেড়ে একটিতে থিতু হবেন বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে ‘মুক্তিযোদ্ধা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ নামে বগুড়ায় ১২টি কলেজ নিয়ে গঠিত ‘মুক্তিযোদ্ধা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ শিক্ষা ট্রাস্টি বোর্ডের’ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মজিবুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘জনবল নিয়োগের নামে কারও কাছ থেকে টাকা নিলে তার দায় রুবেলের; ট্রাস্টির নয়। এমপিও দূরের কথা, প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও স্বীকৃতি পায়নি। এর আগেই আমার নাম ভাঙিয়ে অর্থ লেনদেন দুঃখজনক।’
ভুক্তভোগী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সাত বছর আগে বগুড়ার সোনাতলার আগনেতাইড় গ্রামে বসত গড়েন গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার আরাজি জামালপুর গ্রামের আহম্মেদ আলী সরকারের ছেলে রুবেল। নতুন ঠিকানায় জাতীয় পরিচয়পত্র করে গত ১৭ নভেম্বর জেলা পরিষদ নির্বাচনে সোনাতলা এলাকা থেকে সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৭ সালে গাবতলীর দুর্গাহাটা ডিগ্রি কলেজে ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন রুবেল। এখনও সেখানে কর্মরত থাকলেও দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে গত চার মাস তাঁর বেতন-ভাতা বন্ধ করে দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। তাঁকে স্থায়ীভাবে বরখাস্তের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন ওই কলেজের অধ্যক্ষ মোজাফফর হোসেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ
ও গবেষণা একাডেমি (নেকটা) বগুড়ার সাবেক প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান সরকারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা হয় মুক্তিযোদ্ধা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। ২০১৮ সালের শুরুতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বগুড়ায় এসে একসঙ্গে ১২টি টেকনিক্যাল কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বিনামূল্যে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে এগুলো করা হলেও শিক্ষা কিংবা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি এবং আলাদা নীতিমালা না থাকায় জটিলতা দেখা দেয়। একপর্যায়ে নিয়োগ বাণিজ্য ও আধিপত্যের লড়াইয়ে দুটি পক্ষ এবং হামলা-মামলাও হয়। চার বছর আগে রুবেল গাবতলী মুক্তিযোদ্ধা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন এবং সুযোগ বুঝে আবদুল মান্নানকে হটিয়ে কর্তৃত্ব নেন। অধ্যক্ষের পদও দখলে নেন। পরে এমপিওভুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি শিক্ষকদের একটি পক্ষের সহায়তায় একে একে বগুড়া সদরের নাটাইপাড়া মুক্তিযোদ্ধা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কাহালু মুক্তিযোদ্ধা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও বগুড়া শহরের জামিলনগর মুক্তিযোদ্ধা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষের পদে বসেন। কাগজপত্রে এখনও তিনি প্রতিষ্ঠানগুলোর অধ্যক্ষ। এরই মধ্যে কৌশলে ১২টি উপজেলায় এ ধরনের ১২টি মুক্তিযোদ্ধা টেকনিক্যাল কলেজ পরিচালনার ট্রাস্টি বোর্ডেরও সেক্রেটারি বনে যান রুবেল।
গাবতলী মুক্তিযোদ্ধা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ রোজিনা আক্তার নাইচের অভিযোগ, ২০১৯ সালের আগস্টে রুবেল শিক্ষক-কর্মচারীকে আমার বিরুদ্ধে উসকে দেন। অক্টোবরে সরে গেলে তিনি অধ্যক্ষ হন। এর পর শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে প্রায় ৪৫ ও নিয়োগ বৈধকরণের কথা বলে আরও ৫৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। বিষয়টি নিয়ে নাইচ ও রুবেলের অনুসারীদের মধ্যে একাধিবার সংঘর্ষ এবং পাল্টাপাল্টি মামলা হয়েছে বলেও জানান কলেজের শিক্ষকরা।
সদরের নাটাইপাড়া মুক্তিযোদ্ধা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এমপিও করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রুবেল ২০২০ সালের জুনে অধ্যক্ষের পদে বসেন। এর পর কলেজের নামে জমি কেনা ও এমপিওভুক্তিতে খরচাবাবদ প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদের কাছ থেকে ৭০ লাখ টাকা নেন তিনি। আর শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে আরও ৬৫ লাখ টাকা পকেটে ভরেন। রুবেলের বিরুদ্ধে মামলা করবেন জানিয়ে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘রুবেলের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হতে বসেছে।’
২০২০ সালের আগস্টে সোনাতলা মুক্তিযোদ্ধা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হন রুবেল। এর পর থেকে প্রায় ১ কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য করেন। কলেজের ইংরেজির শিক্ষক রোজিনা আক্তার বলেন, ‘আমার কাছ থেকে রুবেল ২ লাখ টাকা নিয়ে নিয়োগ বৈধকরণের কথা বলে নেন। এভাবে ৪২ শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ বৈধকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রায় কোটি টাকা নিয়েছেন।’
কাহালু মুক্তিযোদ্ধা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে অধ্যক্ষ পদে বসেন রুবেল। এর পর থেকে অর্ধকোটি টাকা নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। প্রতিষ্ঠানের ল্যাব সহকারী পদে চাকরি দেওয়ার নামে ৮ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগে গত ৭ ফেব্রুয়ারি রুবেলের বিরুদ্ধে সদর আদালতে মামলা করেন তানভির রহমান। একই আদালতে গত ডিসেম্বরে ৫ লাখ টাকা নিয়ে ভুয়া নিয়োগপত্র দেওয়ার অভিযোগ এনে মামলা করেন মরিয়ম বেগম।
তবে ভিন্ন কায়দায় রুবেল সবচেয়ে বড় নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন গত বছরের ২৮ জুন। ১২টি কলেজে নিয়োগ ও পুনর্নিয়োগ এবং চাকরি নিয়মিতকরণের নামে ৬৪২ জনবল নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেন পত্রিকায়। ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এরই মধ্যে তিনি বিভিন্নজন থেকে অন্তত ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মজিবুর রহমান মজনু থাকলেও কলকাঠি নাড়েন রুবেল। অভিযোগ রয়েছে, মজনুর তৃতীয় স্ত্রী শিল্পীকে ম্যানেজ করে রমরমা নিয়োগ বাণিজ্য করছেন রুবেল।
কলেজগুলোর প্রতিষ্ঠাতা আবদুল মান্নান সরকার সমকালকে বলেন, ‘স্বীকৃতি ও এমপিও পেতে বিলম্ব হওয়ায় রুবেল শিক্ষক এবং এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে উসকে দেন। একপর্যায়ে তিনি চারটি কলেজের স্বঘোষিত অধ্যক্ষ ও অবৈধ ট্রাস্টি বোর্ডের সেক্রেটারি সেজে ব্যাপক হারে নিয়োগ বাণিজ্য শুরু করেন। এখন সবার কাছে রুবেলের ধান্ধা পরিষ্কার, ভুক্তভোগীরা আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন। আমার সঙ্গেও যোগাযোগ করছেন। সবাইকে নিয়ে আমি কলেজগুলোকে রক্ষার চেষ্টা করছি।’
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হযরত আলী বলেন, ‘এমপিওভুক্ত একাধিক কলেজে একসঙ্গে অধ্যক্ষ থাকার কোনো সুযোগ নেই। অনুমোদন না থাকায় এসব টেকনিক্যাল কলেজের বিষয়ে এ মুহূর্তে কিছু করার নেই।’
মন্তব্য করুন