খুলনায় বন্ধ থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত প্লাটিনাম জুট মিলের যান্ত্রিক বিভাগের শ্রমিক ছিলেন মন্টু মিয়া। কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে দু’বছর আট মাস হয়ে গেল। এতদিনে সোনালি আঁশ নিয়ে কর্মব্যস্ত দিনগুলোর স্মৃতি ভুলতে বসার কথা। কিন্তু হয়েছে তার বিপরীত; বকেয়া টাকা আদায়ের যন্ত্রণা তাঁর মতো অনেকের সুখের স্মৃতিগুলোকে তেতো করে দিচ্ছে! ঘামঝরা কাজের মজুরি, সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন পাওনা এখনও ঝুলে আছে নানা ছুঁতায়। এ অফিস থেকে সে অফিস ঘুরতে ঘুরতে জুতার তলা ক্ষয় হয়ে গেলেও আশ্বাস ছাড়া মিলছে না কিছুই।

নগরীর খালিশপুর প্লাটিনাম জুট মিলের শ্রমিক-কর্মচারী কলোনির ২ নম্বর গেট সংলগ্ন একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন মন্টু মিয়া। তিনি বলেন, আমার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলেটা দিনমজুর হিসেবে কাজ করে। তার সামান্য আয় দিয়ে কোনো রকমে চলছি। সঞ্চয়পত্র পেলে মাসে কিছু টাকা আসত। ঘর ভাড়া, বাজারঘাট, বিদ্যুৎ বিলসহ অনেক খরচ। মিল হঠাৎ করে বন্ধ হওয়াতে ছেলেদের ওপর চাপ পড়েছে। কারও কাছে হাতও পাততে পারি না।

তিনি আরও বলেন, প্রায় ৯ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পাওনা আছে। স্ট্রোক করেছি প্রায় এক মাস। অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করতে পারছি না। ওঠাবসা করতে কষ্ট হয়। এর পরও পাওনা টাকাগুলোই পাচ্ছি না। তাহলে টাকা কি মরে গেলে দেওয়া হবে?

শুধু মন্টু নন, নামের বানানে ভুল, মামলা-সংক্রান্ত জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে এখনও নগদ টাকা এবং সঞ্চয়পত্র পাননি খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলের প্রায় ২ হাজার স্থায়ী ও বদলি শ্রমিক। তাঁদের পাওনার পরিমাণ প্রায় ৮৯ কোটি টাকা। এই অর্থ না পেয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাতে হচ্ছে তাঁদের। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে রোজায়। ঈদ সামনে রেখে কী করবেন ভেবে কূলকিনারা করতে পারছেন না তাঁরা।

একই মিলের শ্রমিক মহিউদ্দিন বলেন, নামের বানানে ভুল ছিল। মিল কর্তৃপক্ষ আমার নাম মহিউদ্দিনের পরিবর্তে মঈনউদ্দীন লিখেছে। সেই ভুলের জন্য এখনও ভুগছি। এজন্য আরও ৮ লাখ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও দিচ্ছে না। আমার মতো অনেকেই অনুরূপ সমস্যায় পড়েছেন।

বিজেএমসি সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকল বন্ধ করে দেয় সরকার। এর পর শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ কার্যক্রম শুরু হয়। তবে নানা জটিলতায় আলীম, কার্পেটিং, ক্রিসেন্ট, ইস্টার্ন, জেজেআই, প্লাটিনাম ও স্টার জুট মিলের ২১৮ স্থায়ী শ্রমিক নগদ পাওনা ৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা এখনও পাননি। মিলগুলোর ১ হাজার ৪৬৪ স্থায়ী শ্রমিক বুঝে পাননি ৮১ কোটি ৯৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। ১ কোটি ১০ লাখ টাকা পাওনা আছে ৩৩৫ বদলি শ্রমিকের।

প্লাটিনাম জুট মিল সিবিএর সাবেক সভাপতি খলিলুর রহমান বলেন, পাটকল বন্ধের পর দুই বছর আট মাস অতিবাহিত হলেও সব শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ হয়নি। মিল বন্ধের দুই মাসের মধ্যে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ এবং তিন মাসের মধ্যে মিল পুনরায় চালুর ব্যাপারে বিজেএমসি প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এ কারণে শ্রমিকরা অর্থাভাবে খুব কষ্টে জীবন অতিবাহিত করছেন।

বিজেএমসির খুলনা আঞ্চলিক সমন্বয়কারী গোলাম রব্বানী বলেন, পাটকলগুলোর অধিকাংশ শ্রমিকের বকেয়া পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে। তবে কিছু শ্রমিকের গেট পাস ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নামের বানান দু’রকম পাওয়া গেছে। কারও বিষয়ে মামলা চলছে। নামের ভুল ও মামলা-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে কিছু সংখ্যক শ্রমিকের নগদ টাকা ও সঞ্চয়পত্র দেওয়া এখনও বাকি আছে। সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানের জন্য চেষ্টা চলছে।

বকেয়া পাওনা দাবিতে কর্মসূচি: পাটকল শ্রমিকরা গত মঙ্গলবার খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তিন দফা দাবি জানিয়েছেন। এগুলো হলো– ঈদের আগে বকেয়া টাকা প্রদান, রাষ্ট্রীয় মালিকানায় মিলগুলো পুনরায় চালু এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণ ও বিচার। দাবি আদায়ে আজ শুক্রবার বিকেল ৩টায় গেট সভা, ৩ এপ্রিল সকাল ১০টায় জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান ও ১০ এপ্রিল সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত নতুন রাস্তা মোড়ে মানববন্ধনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।