কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে এক সপ্তাহ ধরে ভেসে আসছে সামুদ্রিক বর্জ্য। জোয়ারের সঙ্গে সৈকতের কবিতা চত্বর থেকে দরিয়া নগর পয়েন্ট পর্যন্ত অন্তত ১২ কিলোমিটার এলাকায় এ ‘বর্জ্যবন্যা’ দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে– জেলেদের ব্যবহার্য ছেঁড়া জাল, প্লাস্টিকের দড়ি, বোতল, স্যান্ডেল, ব্যাগ ও মেডিকেল বর্জ্য। একই সঙ্গে ভেসে আসে বিভিন্ন ধরনের শুকনো লতাগুল্ম ও কাঠের টুকরা এবং মৃত সামুদ্রিক প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। বর্জ্যগুলো একদিকে যেমন পরিবেশের ক্ষতি করছে, অন্যদিকে সৈকতে পর্যটকদের হাঁটা-চলায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।

সমুদ্রবিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্তমানে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত মাইক্রোপ্লাস্টিকের উৎসে পরিণত হয়েছে। অবিলম্বে এই বর্জ্য অপসারণ না হলে সৃষ্ট মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে মানুষের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

জানা যায়, সামুদ্রিক জোয়ারের সঙ্গে কক্সবাজার সৈকতে মাঝেমধ্যেই ভেসে আসে নানা সামুদ্রিক প্রাণীর মৃতদেহ। এর মধ্যে ২০২০ সালের জুলাইয়ে কলাতলী থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার এলাকায় দুই দফায় ‘বর্জ্যবন্যা’ দেখা দেয়। ওই সময় নানা বর্জ্যের সঙ্গে মৃত কচ্ছপ, সাপসহ আরও বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর মৃতদেহ ভেসে আসে। ২০২২ সালের অক্টোবরে সিত্রাংয়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসেও সোনাদিয়া সৈকতসহ কক্সবাজারের সাগর ও নদীতীরবর্তী উচ্চ জোয়ার প্লাবিত অঞ্চলে শত শত টন প্লাস্টিক বর্জ্য আছড়ে পড়ে।

কক্সবাজার সৈকত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে ‘প্রকৃতি ও প্রযুক্তি অধ্যায়ন’। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আহমদ গিয়াস বলেন, সাগরে প্লাস্টিক দূষণ কমাতে ভূমির বর্জ্য যাতে সরাসরি সাগরে না যায়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন সৈকতে ভেসে আসা জৈব-অজৈব বর্জ্যগুলো সংগ্রহের পর পুঁতে ফেলা হচ্ছে। প্লাস্টিকের মতো অজৈব বর্জ্যগুলো পুঁতে ফেলার ফলে মাটির ভয়ংকর দূষণ ঘটতে পারে।

সৈকতের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু সুফিয়ান বলেন, শহরের পাহাড়ের কাদামাটি ও বিভিন্ন বর্জ্য বাঁকখালী নদী হয়ে সাগরে যাচ্ছে। আর সৈকত হয়ে তা আবার ফিরে আসছে। বর্ষা মৌসুমে এ অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে এসব বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে সৈকত এবং সাগরের পানির পরিবেশ রক্ষায় নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আবু সুফিয়ান আরও বলেন, এক সপ্তাহ ধরে কক্সবাজার সৈকতে যে ময়লা ভেসে এসেছে, তা পরিষ্কারের জন্য আমরা পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্নকর্মী রেখেছি, যাতে এগুলো পরিষ্কার করা যায়।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার পারভেজ বলেন, সৈকতে বর্জ্য আসার ঘটনা সমুদ্রে নিম্নচাপ, বায়ুপ্রবাহ, পানির ঘূর্ণন (এডি), পানির গতিপ্রবাহসহ সমুদ্রপৃষ্ঠের ধরনের ওপর ভিত্তি করে সমুদ্র উপকূলের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় ভাসমান প্লাস্টিকসহ অন্য বর্জ্য জমা হয়।

বেলাল হায়দার বলেন, সমুদ্রে সম্প্রতি আমরা একটি নিম্নচাপের অবস্থান লক্ষ্য করেছি, এসব নিম্নচাপের জোয়ারের সময় সমুদ্র উপরিপৃষ্ঠের পানি অতি মাত্রায় বেড়ে গিয়ে ফুলে ওঠে এবং ঘূর্ণনের ফলে সমুদ্রের ভাসমান প্লাস্টিক বর্জ্য একসঙ্গে জমা হয়ে ভেসে আসে সৈকতে। যেসব জায়গার ভেজিটেশন লাইন ও ওয়াটার লাইনের দূরত্ব বেশি, সেখানে জোয়ারের পানি আসতে না পারায় প্লাস্টিক বর্জ্য প্রায়ই দরিয়া নগর থেকে সোনাদিয়া-মহেশখালী সমুদ্রকূলে আটকা পড়ে।

তিনি আরও বলেন, বর্জ্য ভেসে আসার কারণ আরও গভীরভাবে জানার জন্য বে অব বেঙ্গলের সিজনাল এডি ফরমেশন (পানির ঘূর্ণন), বায়ুপ্রবাহের গতি ও দিক এবং কক্সবাজার কোস্টাল এলাকার বটম ট্রপগ্রাফির ওপর গবেষণা দরকার। বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলামের নেতৃত্বে সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এসব বর্জ্যের উৎস জানতে নমুনা সংগ্রহ করেছেন।