পবিত্র রমজানে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লুটতে সাধারণ ক্রেতাদের পকেট কাটার মহোৎসবে মেতে উঠেছে দেশের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের অসাধু ব্যবসায়ী-আমদানিকারকরা। কেনা দামের চেয়ে কয়েক গুণ লাভ করতে নতুন কৌশল হিসেবে বিক্রির রসিদ ‘গায়েব’ করে ফেলছে তারা। এর মাধ্যমে তারা প্রশাসনের কাছে তাদের প্রতারণা এড়াতে চাইছে। 

রমজানে ভোগ্যপণ্যের বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে বিক্রির রসিদ গায়েব করার কাজে একজোট হয়েছে অনেক ব্যবসায়ী। অস্বাভাবিক বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি করে মুনাফা হাতিয়ে নিলেও দোকানে রাখা হচ্ছে না এ-সংক্রান্ত কোনো রসিদ কিংবা ডকুমেন্ট।

তাদের এ কৌশলে অসাধুদের পকেট ভরলেও ঠকছেন ক্রেতারা। প্রতারণার এ প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ছে খাতুনগঞ্জ থেকে চট্টগ্রামের অন্য বাজারেও। কিছু বড় ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকের হাতে এই কৌশলে জিম্মি হয়ে পড়ার বিষয়টি জানিয়ে চট্টগ্রাম থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। প্রতারণায় জড়িতদের ওপর বাড়তি নজরদারি রাখার কথা বলছে প্রশাসন।

প্রতারণায় জড়িত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একটি খাতুনগঞ্জের আরএম ট্রেডার্স। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কেনা পণ্যের রসিদ সংরক্ষণ করলেও প্রতিদিন বাড়তি দামে বিক্রি করার তথ্য সংরক্ষণ করে না প্রতিষ্ঠানটি। কেনা দামের চেয়ে কয়েক গুণ বেশিতে ভোগ্যপণ্য বিক্রির প্রমাণ মিলেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। এ অনিয়মের প্রমাণ হাতেনাতে পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে অর্ধলাখ টাকা জরিমানা করেছে প্রশাসন।

একইভাবে খাতুনগঞ্জের জুয়েল এন্টারপ্রাইজও রসিদ গায়েব করেছে। জানা গেছে,  এ প্রতারণায় আরও আছে হাজি জসিম ট্রেডার্স, এফসি ট্রেডার্স, আল মদিনা, সবুর স্টোর, আলিফা এন্টারপ্রাইজ, মিজান অ্যান্ড ব্রাদার্স, মায়েদা ট্রেডার্স, আলী জেনারেল ট্রেডিং, জিহাদ এন্টারপ্রাইজসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান। প্রতারণায় এই কৌশল খাতুনগঞ্জ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে চট্টগ্রামের আরেক বৃহৎ বাজার রেয়াজউদ্দিনসহ আরও কয়েকটি বিক্রয়কেন্দ্রে।

বিভিন্ন উৎপাদনকারী ও আমদানিকারকের কাছ থেকে বিক্রির রসিদ না পাওয়ায় নানা সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার কথা উল্লেখ করে চট্টগ্রামের কয়েকটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতির কাছে চিঠি দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি জানিয়ে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে চট্টগ্রাম চেম্বার।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘রমজানকে টার্গেট করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নানা কৌশল অবলম্বন করছে। এর বেশকিছু প্রমাণও আমরা পেয়েছি। অনেকে কেনা দামের চেয়ে অযৌক্তিক বাড়তি দামে ভোগ্যপণ্য বিক্রি করলেও এর কোনো রসিদ সংরক্ষণ করছে না। বিষয়টি উদ্বেগের। কারসাজির বিষয়টি আমাদের নজরদারিতে আছে। এ জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নানা দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক বলেন, ‘যে দামে ভোগ্যপণ্য কেনা হয়েছে, তার রসিদ আছে। কিন্তু একই পণ্য বাড়তি দামে বিক্রি করার রসিদ নেই ব্যবসায়ী-আড়তদারদের কাছে। এই কাজে বড় মিল মালিক, ব্যবসায়ী-আমদানিকারকরা জড়িত বলে তথ্য পেয়েছি আমরা। এ কৌশল অবলম্বন করে তারা একদিকে যেমন ক্রেতাদের ঠকাচ্ছে, অন্যদিকে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের ওপর বাড়তি নজরদারি রয়েছে আমাদের। তাদের কয়েকজনকে এরই মধ্যে চিহ্নিতও করা হয়েছে।’

চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, যত বড় ব্যবসায়ী বা আমদানিকারক হোক না কেন, অবশ্যই বিক্রির রসিদ রাখতে হবে। রসিদ না রাখার অভিযোগ পাওয়ায় তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।

খাতুনগঞ্জের এক আমদানিকারক বলেন, কয়েকটি শিল্প গ্রুপ, ভোগ্যপণ্যের মিল মালিক এবং বড় ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা বিক্রির রসিদ দিচ্ছেন না।

এদিকে, রমজানে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলা ও মহানগরে ৪০টি মনিটরিং টিম মাঠে নামিয়েছে জেলা প্রশাসন। এ জন্য জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষও চালু করা হয়েছে। উপজেলায়ও মনিটরিং টিম কাজ করছে। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা ও বাজার কমিটির প্রতিনিধিরা মনিটরিং টিমের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজির কারণে বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে প্রশাসন।

চট্টগ্রাম নাগরিক উদ্যোগের প্রধান উপদেষ্টা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন, রমজানের সময়েও বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে যারা দাম বৃদ্ধি করে ক্রেতাদের পকেট কাটে, তারা গণদুশমন। তাদের হাত থেকে ভোক্তাদের রক্ষা করতে প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজার পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান ক্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, অসাধু ব্যবসায়ী-আমদানিকারকদের কাছে ভোক্তারা জিম্মি হয়ে পড়েছে। তাদের অতিমুনাফার কারণে প্রায় প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। বিক্রির রসিদ না রাখা তাদের অসাধু উপায় অবলম্বনের বড় উদাহরণ। এ ধরনের কারসাজিতে জড়িতদের বড় অঙ্কের জরিমানার পাশাপাশি কারাদণ্ডও দিতে হবে।