গত মাসের চতুর্থ সপ্তাহে র‍্যাব হেফাজতে নওগাঁ সদরের চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের অফিস সহকারী সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনা অনেক দূর গড়িয়েছে। এতে র‍্যাবের একটি টিম এবং রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের পরিচালক (স্থানীয় সরকার) যুগ্ম সচিব এনামুল হকের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ এক কর্মকর্তার নাম একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পরও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নিজে থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে দায়িত্ব পালনের এক ধরনের দায়সারা কার্যক্রম পরিলক্ষিত।

 এ অবস্থায় গত ৫ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ যদি তার যথাযথ দায়িত্ব পালন করত তাহলে আদালতের মাধ্যমে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ আসার প্রয়োজন হতো না। সরকারের কোন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ কী কী কাজ করবে, তা রুলস অব বিজনেস দ্বারা নির্ধারিত। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বয়ের ভূমিকা পালন করে।

রুলস অব বিজনেসে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ২৬টি সুনির্দিষ্ট দায়িত্বের কথা বলা আছে। এর মধ্যে ১৪ নম্বরে ‘উপজেলা, জেলা ও বিভাগের সাধারণ প্রশাসন’ দেখভালের দায়িত্বের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ মাঠ প্রশাসনের সার্বিক (উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় কমিশন অফিস) কার্যক্রম দেখার দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের। তাই রাজশাহী বিভাগীয় কমিশন কার্যালয়ের যুগ্ম সচিব এনামুল হকের নাম যখনই সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় এসেছে, তখনই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারত। পারত যুগ্ম সচিবকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করতে। কোনোটাই করেনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

যুগ্ম সচিব এত বড় ঘটনার সঙ্গে জড়িত, অথচ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নিল না কেন? বাস্তবতা হচ্ছে, মাঠ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের। রুলস অব বিজনেসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ৬০টি নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের কথা উল্লেখ আছে। এর মধ্যে ৩১ নম্বরে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় কমিশনের সব ধরনের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে আলোচনাক্রমে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ মাঠ প্রশাসনের বদলি, পদায়নের সব আদেশ-নির্দেশ জনপ্রশাসন থেকে জারি হয়। কিন্তু মাঠ প্রশাসনের কারও বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরামর্শ নিতে হয়।

প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণে দেখা গেছে, ২২ মার্চ সুলতানা জেসমিনকে তুলে নেওয়ার পর ২৪ মার্চ তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এর পর র‍্যাব তাদের একটি নিজস্ব তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। অন্যদিকে ঘটনার বিষয়ে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার একটি প্রাথমিক রিপোর্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছেন। কিন্তু সে প্রতিবেদনে যুগ্ম সচিবের সম্পৃক্ততার কথাটি উহ্যই থেকে গেছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, ওই প্রতিবেদন দিয়ে যুগ্ম সচিবের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। তাই আবারও প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য বিভাগীয় কমিশনারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ যে বিভাগীয় কমিশনার ঠিকভাবে তথ্য দেননি বা তথ্য গোপন করেছেন, তাঁকেই আবার প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে সর্বোচ্চতম পদ। সেই হিসাবে অফিস সহকারী সুলতানা জেসমিনেরও পরোক্ষ দাপ্তরিক প্রধান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি তাঁর অধীনস্থ এই কর্মচারীর প্রাণহানি নিয়ে অবহেলা করলেন কেন? মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগের দায়িত্ব এ ধরনের পরিস্থিতিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে ঠিকভাবে তথ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করা। সেটা কি অনুবিভাগটি করেছিল?

আমরা স্মরণ করতে পারি, ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে জামালপুরের তৎকালীন ডিসি তাঁর অধীনস্থ কর্মচারীর সঙ্গে আপত্তিকর সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। সেই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ত্বরিত উদ্যোগ নিয়েছিল। এক যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে সরেজমিন তদন্ত শেষে ওই ডিসির বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলায় শাস্তি হয়েছে। যদিও তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই ডিসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল।

জামালপুরের ঘটনায় কারও প্রাণহানি ঘটেনি। সেদিক থেকে নওগাঁর ঘটনা অনেক বেশি গুরুতর। কারণ এই ঘটনায় একজনের প্রাণ গেছে। হ্যাঁ, তাঁর পদবি সরকারের সবচেয়ে নিম্ন গ্রেডের। পদের কারণেই কি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে উপেক্ষিত হলেন সুলতানা জেসমিন? যুগ্ম সচিবের ‘এলিট’ ভাবমূর্তির কাছে হেরে গেছে অফিস সহকারীর প্রাণ? মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগের দায়িত্বশীল পদে থাকা প্রায় সবাই ইউএনও-ডিসি হিসেবে কাজ করে এসেছেন। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বর্তমান মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগ সেই স্মার্টনেসটুকু দেখাতে পারল না? সব মিলিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বশীলতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেল। আসলে শুধু ইউএনও এবং ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেই দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হওয়া যায় না; প্রয়োজন জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে নির্ভীকভাবে কাজ করা।

গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর দৈনিক সমকালে একটি শীর্ষ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল– ‘প্রশাসনে যোগ্য কর্মকর্তার অভাব’। প্রতিবেদনটি নিয়ে সচিবালয় ও মাঠ প্রশাসনে আলোচনা হয়েছিল। পরিচিত কর্মকর্তার বেশিরভাগের কাছ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। কেউ কেউ সমালোচনাও করেছেন। বলেছেন, কয়েকজন কর্মকর্তাকে কেন্দ্র করে লেখা প্রতিবেদনে পুরো প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যৌক্তিক হয় না। কিন্তু সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় আরেকবার প্রমাণ হলো– প্রশাসনে যোগ্য ও উদ্যমী কর্মকর্তার কত অভাব!

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে প্রশাসনের শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে থাকেন সবচেয়ে যোগ্য কর্মকর্তারা। বাকি সব কর্মচারী যোগ্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ পালন করেন। আর মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা হলেন বিভাগীয় কমিশনার। তার মানে, যোগ্যতা ও দক্ষতা বিবেচনা করেই তাঁকে ওই পদে বসানো হয়েছে। রাজশাহীর ঘটনায় বিভাগীয় কমিশনার জানতেন, যুগ্ম সচিব এনামুল হক কোনো দাপ্তরিক নির্দেশ ছাড়াই র‍্যাবের সঙ্গে অভিযানে গিয়েছেন এবং ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই সুলতানা মারা গেছেন। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো রিপোর্টে বিভাগীয় কমিশনার সেটি উল্লেখ করেননি। নিজের উচ্চপদস্থ সহকর্মীকে বাঁচাতে গিয়ে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার পদে নিযুক্ত অতিরিক্ত সচিব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগের উচিত ছিল সঠিক তথ্য ও পরামর্শ সচিবকে দেওয়া। তাঁরাও সেটা পারেননি। শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতকে নির্দেশ দিতে হলো। রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশন এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগে যোগ্য কর্মকর্তা থাকলে কি পরিস্থিতি এমন হতো?

বাহরাম খান: জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, সমকাল