ঈদুল ফিতর সামনে রেখে বগুড়ার লাচ্ছা সেমাইয়ের চাহিদা থাকে অন্তত ২৫টি জেলায়। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এ সেমাইয়ের বাজার তৈরি হয়েছে দেড় যুগ আগে থেকে। অর্ডার অনুযায়ী, শবেবরাতের পর থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় ট্রাক-পিকআপে এ সেমাই সরবরাহ করা হয়ে থাকে। টাকার অঙ্কে এর বাজার প্রায় ২৬০ কোটি টাকা। কিন্তু এবার অর্ডার কমে গেছে। ফলে অর্ধেকে নেমেছে বগুড়ার লাচ্ছা সেমাই শিল্পের বাজার। বন্ধ হয়েছে ২০ শতাংশ কারখানা।

এ শিল্পে ধস নামা প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীরা বলছেন, লাচ্ছা সেমাই তৈরির কাঁচামাল হিসেবে অপরিহার্য সব উপাদানের দাম বেড়েছে। আগের বছর পাম অয়েলের দাম ছিল ড্রামপ্রতি ১৭ হাজার টাকা। এখন সেই তেলের ড্রাম ব্যবসায়ীদের কিনতে হচ্ছে ২৫ হাজার টাকায়। ডালডার অবস্থাও একই। লাচ্ছা তৈরিতে এ ডালডা অপরিহার্য। গত বছর ডালডার ১৬ কেজির প্রতিটি কার্টনের দাম ছিল ১ হাজার ৬০০ টাকা। দাম বেড়ে বর্তমানে তা হয়েছে ২ হাজার ৮০০ টাকা।

লাচ্ছা সেমাই উৎপাদনের কারখানা সূত্রে জানা যায়, ময়দা-আটার দামও বেড়েছে। গত বছর ৭৪ কেজির প্রতি বস্তা ময়দার দাম ছিল ৩ হাজার টাকা। সেই ময়দা এবার কিনতে হচ্ছে ৪ হাজার টাকায়। অর্থাৎ বস্তাপ্রতি ময়দার দাম বেড়েছে কমপক্ষে ১ হাজার টাকা।

জেলার শাজাহানপুর উপজেলার লাচ্ছা সেমাই কারখানার মালিক আব্দুল মোত্তালেব জানান, কাঁচামালের দাম বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে শ্রমিকের মজুরির মূল্য। এ সেমাই তৈরির ক্ষেত্রে বস্তাপ্রতি হিসাবে শ্রমিকরা কাজ করে থাকেন। এক বস্তা সেমাই তৈরির জন্য শ্রমিকরা গত বছর মজুরি নিয়েছিলেন ৪৫০ টাকা। এবার শ্রমিক মজুরি দাঁড়িয়েছে ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকায়। খড়ি, ডিজেলসহ সব ধরনের জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয় বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। ভ্যাট-ট্যাক্স বেড়েছে ১৫ শতাংশ। এ কারণে লাচ্ছা সেমাইয়ের দামও বেড়েছে। গত বছর যে লাচ্ছা বিক্রি হয়েছে (খোলা) ২০ কেজির খাঁচি ১ হাজার ৩০০ টাকায়, এবার তা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪০০ টাকায়। চিকন সেমাই ১ হাজার ২০০ টাকার খাঁচি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৯০০ টাকায়।

বগুড়ার অন্যতম লাচ্ছা সেমাই উৎপাদন প্রতিষ্ঠান খাজা বেকারি। উত্তরাঞ্চলের আট জেলায় যায় তাদের সেমাই। শবেবরাতের পর থেকে অর্ডার অনুযায়ী সেমাই পাঠাতে থাকেন তাঁরা। কিন্তু গত বছর যাঁরা এক টন লাচ্ছা সেমাইয়ের অর্ডার দিয়েছিলেন, এবার তাঁরা অর্ডার অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছেন।

খাজা বেকারির এ সেমাইয়ের ডিলার লালমনিরহাটের রবিউল ইসলাম বলেন, তিনি প্রতিবছর এক টনেরও বেশি লাচ্ছা বিক্রি করতেন। শবেবরাতের পর থেকেই এ সেমাই বিক্রি শুরু হয়। কিন্তু এবার ১৫ রোজা চলে যাচ্ছে, সেমাইয়ের ক্রেতা নেই। যাঁরা কিনছেন, তাঁরা গত বছরের তুলনায় অর্ধেক কিনছেন।

বগুড়া শহরের খুচরা সেমাই বিক্রেতারাও একই অভিযোগ করেছেন। ক্রেতারা আগের তুলনায় লাচ্ছা সেমাই কেনা কমিয়েছেন। শহরের ফহেতআলী বাজারের মুদি দোকানি জীবন কুমার বলেন, ঈদ মৌসুমে লাচ্ছা সেমাই বিক্রি করেই বেশ লাভ হতো। ক্রেতারাও প্রথম রোজা থেকেই সেমাই কিনতেন। কিন্তু এবার তাঁদের আগ্রহ নেই। যাঁরা এক কেজি কিনতেন, তাঁরা কিনছেন আধা কেজি।

শহরের খান্দার এলাকার বাসিন্দা আব্দুল মোমিন জানান, তিনি প্রতিবছর প্রথম রোজার দিন থেকেই সেমাই কেনেন ইফতারের জন্য। কিন্তু এবার কেনা সম্ভব হয়নি। ঈদের জন্য কিছু কিনবেন।

বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কুট অ্যান্ড কনফেকশনারি দ্রব্য প্রস্তুতকারক সমিতি উত্তরবঙ্গ পরিষদের সহসাধারণ সম্পাদক ও খাজা কনফেকশনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বায়েজিদ শেখ বলেন, লাচ্ছা সেমাই তৈরির উপকরণের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ। তাই উৎপাদন খরচ বাড়ায় দামও বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতা কমে যাচ্ছে। এতে পাইকারি ক্রেতারা অর্ডার কমিয়েছেন।

বগুড়ায় ছোট-বড় মিলে ২০০ কারখানায় লাচ্ছা সেমাই তৈরি করা হয়। তবে এবার ২০ শতাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, উৎপাদন খরচের তুলনায় সেমাই বিক্রি করে পোষাতে পারছেন না। জেলার সদর উপজেলার মানিকচক এলাকার মদিনা লাচ্ছা সেমাই কারখানার মালিক জাহিদুল ইসলাম বলেন, দুই যুগ ধরে তিনি এ ব্যবসা করেন। কিন্তু উৎপাদন উপকরণের দাম গত দুই বছর থেকে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এতে এবার তিনি উৎপাদন বন্ধ রেখেছেন।

ব্যবসায়ীদের দাবি, প্রতিবছর ঈদে জেলার বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদন ছিল ২০ হাজার টন সেমাই। এর বাজার মূল্য ২৬০ কোটি টাকা। এবার উৎপাদন ১২ হাজার টনের বেশি হবে না। ফলে লাচ্ছা সেমাইয়ের বাজার অর্ধেকে নেমেছে।

বগুড়া জেলা বেকারি মালিক সমিতির সভাপতি আকবরিয়া লিমিটেডের চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল জানান, তাঁদের উৎপাদিত লাচ্ছা সেমাই ২৫টি জেলায় যায়। কিন্তু উপকরণের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এবার আগের বছরের মতো উৎপাদন করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, বগুড়ার লাচ্ছা সেমাইয়ের বাজারের পরিধি কমে আসছে। এ শিল্পে ধস নেমেছে।