ইয়াবার পাশাপাশি মাদকসেবীদের কাছে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে ক্রিস্টাল মেথ বা আইস। অবৈধভাবে মিয়ানমার থেকে ঢুকে বাংলাদেশের নানা প্রান্তে ভয়ংকর এই মাদক ছড়িয়ে পড়ছে। পরিবহনে সুবিধা ও ইয়াবার তুলনায় ১০ গুণ উত্তেজক হওয়ায় এই মাদকের দিকে ঝুঁকছে বিপথগামী তরুণরা। দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায়ই আইসের ছোট-বড় চালান জব্দ হচ্ছে। সর্বশেষ গতকাল বুধবার ভোরে কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী সীমান্তে অভিযান চালিয়ে ২১ কেজির চালান জব্দ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এ সময় পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে তিনজনকে আটক করা হয়। তাঁরা হলেন– বুজুরুছ মিয়া এবং তাঁর দুই সহযোগী ইসমাইল ও ছৈয়দুল বাশার। তাঁরা সবাই উখিয়ার বালুখালীর বাসিন্দা। বিজিবি বলছে, এখন পর্যন্ত এটি দেশে সবচেয়ে বৃহৎ চালান জব্দের ঘটনা। 

সমকালের তথ্য অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের ইতিহাসে আইসের সর্ববৃহৎ চালানের অর্থ লগ্নিকারী এই বুজুরুছ মিয়া। বালুখালী এলাকায় পানের বৃহৎ পাইকারি বাজার রয়েছে। পৌনে ৪ কোটি টাকায় ওই হাট ইজারা পান তিনি। এই হাট ইজারা নেওয়ার পেছনে বড় কারণ, এটি

মাদক পাচারের বড় একটি রুট। এটি নিয়ন্ত্রণে রাখলে মাদক পাচারকাজ সহজ হয়। জব্দ আইসের কারবারে প্রধান অর্থ লগ্নিকারীও বুজুরুছ। এলাকায় তিনি বাইট্যা শহীদ নামে পরিচিত। বেশভুষা দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি কতটা ধনাঢ্য। বাসার আশপাশে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো রয়েছে। এই চালানে ছৈয়দুল বাশারও টাকা লগ্নি করেন। সাধারণত দেশের বাজারে প্রতি কেজি আইসের দাম ৫ কোটি টাকা। এই হিসাবে জব্দ চালানের মূল্য ১০৫ কোটি টাকার বেশি। 

বিজিবির রামু সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মেহেদি হোসাইন কবির সমকালকে বলেন, মাদক কারবারিদের প্রতি আমাদের কড় নজরদারি রয়েছে। অনেক সময় মাদক জব্দ করলেও লগ্নিকারকদের পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়। এবারের অভিযানে মূল লগ্নিকারকও গ্রেপ্তার হয়েছে।  
দেশের সব সংস্থার পৃথক অভিযানে ২০২১ সালে ৩৬ কেজি আইস জব্দ করা হয়। ২০২২ সালে জব্দ হয়েছে ১১৩ কেজি ৩৩১ গ্রাম। দেশের ইতিহাসে প্রথম ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদপুর থেকে ৮ গ্রাম আইসসহ তিনজনকে আটক করা হয়।   
তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর ঢাকায় একটি ল্যাবের সন্ধান মেলে। এর পর ২০১৯ সালের ২৭ জুন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে ক্রিস্টাল মেথসহ একজন নাইজেরীয় নাগরিককে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। 

কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমাদের কাছে তথ্য ছিল, পালংখালী রহমতের বিল সীমান্তের ২০ নম্বর সীমান্ত পিলার এলাকা দিয়ে মিয়ানমার থেকে একটি বড় মাদকের চালান বাংলাদেশে ঢুকবে। সেখানে পালংখালী বিজিবির একটি দল অভিযান চালায়। এ সময় ছয়-সাতজন বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকেই বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে পালানোর চেষ্টা করে। বিজিবি সদস্যরা ধাওয়া করলে তারা দুটি বস্তা ফেলে যায়। ওই মুহূর্তে তিনজনকে আটক করা হয়। পরে ওই বস্তাগুলোতে ২১ কেজি ৯০ গ্রাম আইস পাওয়া যায়।
কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে সংবাদ রয়েছে, আইস মিয়ানমার থেকে আসছে। বিজিবির প্যাট্রল টিমগুলোকেও এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। ইয়াবার বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযান পরিচালনা করা হয়, আইসের ক্ষেত্রেও একই ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ঢোকার সময় অনেক আইস জব্দ করেছে বিজিবি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা দুলাল কৃষ্ণ সাহা সমকালকে বলেন, ইয়াবায় এমফিটামিন থাকে ১০ থেকে ১৫ ভাগ। আর আইসে এমফিটামিন প্রায় ৯৬ শতাংশ। তাই এটি ইয়াবার তুলনায় অনেক গুণ বেশি ক্ষতিকর মাদক। এটি মানবদেহে ইয়াবার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রিস্টাল মেথ বা আইস সেবন করলে কারও স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এটি মানসিক অবসাদ বা বিষণ্নতার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি করে। অন্যান্য শারীরিক ঝুঁকি তো আছেই। ইয়াবার মূল উপাদান দিয়ে পূর্ণাঙ্গ আইস তৈরি হয়। তাই ইয়াবা সেবনে যেসব লক্ষণ বা প্রতিক্রিয়া, সেগুলোই অনেক বেশি মাত্রায় থাকে আইস সেবনের কারণে। মূলত মানসিক ক্ষেত্রে এটি বেশি প্রভাব ফেলে। কেউ আসক্ত হলে, এটি ছাড়া তিনি আর ঘুমাতে পারেন না।

জানা গেছে, উখিয়া- টেকনাফ সীমান্তের অন্তত ১৫ পয়েন্ট দিয়ে ৩৫ জনের নিয়ন্ত্রণে আইস নামের এ মাদক মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসছে। মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছেন কয়েকজন জনপ্রতিনিধিও।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, চিহ্নিত কয়েকজন মাদক কারবারিকে আইসসহ গ্রেপ্তার করা হলেও পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে আবারও তাঁরা একই কাজ করে যাচ্ছেন। এসব মাদক কারবারি প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের নজরদারি করাও কঠিন। যাদের নিয়ন্ত্রণে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আইস আসছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন নবী হোসেন, জাবু, নুরুল আলম, সাইফুল ইসলাম, রাসেল ও মান্নান।

গত ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসে প্রকাশিত ডিএনসির প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজার ও বান্দরবান দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচারের ১৫টি রুট দুর্গম এলাকায় হওয়ায় নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মিয়ানমারের শান ও কোচিন প্রদেশে কারখানা স্থাপন করে ইয়াবা উৎপাদন করা হচ্ছে। এই ১৫টি পয়েন্টের মধ্যে ১০টি কক্সবাজার আর পাঁচটি বান্দরবান সীমান্তে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) সহকারী পরিচালক মোস্তফা কামাল সমকালকে বলেন, যে পথে মিয়ানমার থেকে দেশে ইয়াবার চালান ঢুকছে, সেই একই পথ দিয়ে আসছে আইস। সীমান্তের অন্তত ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ জনের নিয়ন্ত্রণে আইস নামের এ মাদক মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসছে।

বিষয় : উখিয়ায় আইসের ২১ কেজির সর্ববৃহৎ চালান জব্দ

মন্তব্য করুন