- সারাদেশ
- বগুড়ায় বালু কারবারে যুবলীগের ছয় নেতা
বগুড়ায় বালু কারবারে যুবলীগের ছয় নেতা
নেপথ্যে শতকোটি টাকার বাণিজ্য

ফাইল ছবি
বগুড়ায় যমুনা ও বাঙ্গালী নদীতে অবাধে চলছে বালুর কারবার। ফলে দিনের পর দিন ফোকলা হচ্ছে নদীর বুক। হাতেগোনা কিছু বৈধ বালুমহালের আড়ালে শতাধিক পয়েন্ট থেকে উঠছে এই বালু। আর এসবের নিয়ন্ত্রণ করছেন স্থানীয় যুবলীগের ছয় নেতা। তাঁদের নেতৃত্বেই বড় একটি বাহিনী কাজ করছে মাঠে, তারাও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী। অবৈধ এই কারবার চালাতে বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করা হয় টাকা দিয়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই অপতৎপরতা চলতে থাকলে বদলে যেতে পারে নদীর গতিপথ। ভাঙনের মুখে পড়তে পারে জনপদ। ঝুঁকিতে পড়বে তীর সংরক্ষণের ৩০০ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প।
জানা গেছে, দীর্ঘ এক যুগ ধরে চলছে এই বালুর কারবার। অতীতে বহুবার পুলিশ ও জেলা প্রশাসন থেকে অভিযান চালানো হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় ড্রেজার। নিলামে ওঠে অবৈধভাবে উঠানো বালুর পাহাড়। তবু থামছে না অপতৎপরতা।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত ২ অক্টোবর প্রথমবারের মতো বগুড়ায় তিনটি বালুমহাল সরকারিভাবে ইজারা দেওয়ার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে ধুনটের ভান্ডারবাড়িতে ২৬ লাখ সিএফটি, সারিয়াকান্দির নারাপালায় ৩২ লাখ সিএফটি এবং বোহালীতে ৪৮ লাখ সিএফটি বালু তোলার অনুমতি দেওয়া হয়। বগুড়ার সে সময়ের জেলা প্রশাসক জিয়াউল হক ২৩ নভেম্বর এ কার্যাদেশ দেন। কার্যাদেশ অনুসারে বোহালী বালুমহাল ইজারা পান সারিয়াকান্দি যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাছেদুউজ্জামান রাসেল, নারাপালায় সারিয়াকান্দি যুবলীগের সভাপতি আইয়ুব আলী তরফদার এবং ভান্ডারবাড়িতে ধুনট উপজেলা যুবলীগের ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক বেলাল হোসেন। ছয় মাসের জন্য সীমিত পরিমাণ বালু তুলতে কার্যাদেশ দেওয়া হলেও তোলা হয় ৫০ গুণের বেশি। নিয়ম ভেঙে নারাপালার আইয়ুব আলী তরফদার তাঁর পাঁচ সহযোগীকে সাব ইজারাও দেন।
সারিয়াকান্দি ও ধুনট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, যমুনা নদীর বাঁধসংলগ্ন রেড জোন এলাকায় রীতিমতো গড়ে তোলা হয়েছে বালুর পাহাড়। বর্ষার আগেই মজুত করা হয়েছে কোটি কোটি সিএফটি বালু। এখনও সেখানে বাল্কহেড দিয়ে নদী থেকে বালু তুলে আনা হচ্ছে। আশেপাশেই রাখা হয়েছে খননকাজে ব্যবহৃত ড্রেজার মেশিনগুলো। বালু তোলা হয়েছে নদীর ভেতরের কর্ণিবাড়ি, চন্দনবাইশা, আদবাড়িয়া ও বোহালি এলাকা থেকে। সেগুলো মজুত করে রাখা হয়েছে নদীর তীরের রহদহর, চন্দনবাইশা, বড়িকান্দি ও দীঘলকান্দির বিভিন্ন পয়েন্টে। এ ছাড়া ধুনটের গোসাইবাড়ি ও শহরাবাড়ির দুটি পয়েন্টও বালু মজুত করা হয়েছ। উল্লিখিত এসব স্থানে আনুমানিক তিন কোটি সিএফটি বালু মজুত রয়েছে। এখান থেকে প্রতিদিন বালু বিক্রির পর আবার ফাঁকা স্থান ভরাট করে রাখা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন জানান, বৈধতার আড়ালে অবৈধ এসব বালিয়াড়ি থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক বালু বগুড়াসহ আশেপাশের জেলায় বিক্রি করা হয়।
বালুর খেলায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা
যাঁরা বালুর এই অবৈধ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাঁরা সবাই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী। সারিয়াকান্দির নারাপালায় দীঘলকান্দিতে মূল পয়েন্টটি নিয়ন্ত্রণ করেন উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও যুবলীগ সভাপতি আইয়ুব আলী তরফদার। তাঁর সঙ্গী উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিক মাহমুদ আশিক। তিনি কুতুবপুর এলাকার বালুর রাজত্ব করছেন। যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম মনুর বালুর কারবার কর্ণিবাড়ি এলাকায়। একই এলাকায় আলাদা বালুমহাল রয়েছে যুবলীগের সাবেক সভাপতি আব্দুস সালামের। বোহালীতে বালু তুলছেন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাছেদুউজ্জামান রাসেল। এই এলাকায় এককভাবে ব্যবসা করছেন তিনি। এর পাশাপাশি কুতুবপুর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নয়ন শেখ বালুর অবৈধ ব্যবসা খুলে বসেছেন কর্ণিবাড়ি ও দেবডাঙ্গার মাঝখানে। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন কুতুবপুর আওয়ামী লীগের সভাপতি মিঠু শেখ।
এ ছাড়া তাঁদের সহযোগী হিসেবে জোড়গাছায় যুবলীগের মামুন, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি কোরবান আলী ও বীরেণ চন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করেন অবৈধ সাতটি বালুমহাল। দেবডাঙ্গায় বালুর কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম নয়ন, কর্নিবাড়ী ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আজাদ, জোড়গাছা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লালন মিয়া ও ইউপি সদস্য আব্দুর রাজ্জাক।
ধুনট যুবলীগের ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক বেলাল হোসেনের নিয়ন্ত্রণে ভান্ডারবাড়ির বালু। একই উপজেলায় বিলচাপড়ি ঝাঝরা এলাকার বালু কারবারিরা হলেন যুবলীগ কর্মী আলিমসহ তিনজন। শেরপুরের গোপালপুর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন যুবলীগের স্থানীয় নেতা আবদুল হান্নান। দুপচাঁচিয়ার ঘাটমাগরাসহ তিনটি অবৈধ বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করেন আবু তাহের। কাহালুর আটালিয়া বালুমহাল চালাচ্ছেন ফারুক আহম্মেদ।
টাকায় ম্যানেজ
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বালুর কারবার নির্বিঘ্নে চালাতে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে কমিশনের টাকা পাঠাতে হয়। এই টাকা বালু উত্তোলনকারীরা প্রতি মাসে আগাম দিয়ে আসেন উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের। একই সঙ্গে স্থানীয় পুলিশও মাসিক ভিত্তিতে এই বালুর টাকা পেয়ে থাকে। এলাকাভেদে রাজনৈতিক নেতারাও এই টাকার ভাগ পান। কিছু নামধারী সাংবাদিকও মাসিক চুক্তিতে বালুর টাকা নিয়মিত পকেটে তোলেন।
ঝুঁকিতে মেগা প্রকল্পের বাঁধ
যমুনা নদীর ভাঙন থেকে সারিয়াকান্দি রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় কামালপুর ইউনিয়নের রৌহদহ থেকে কুতুবপুর ইউনিয়নের শেষ সীমা পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার নদী শাসন করে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড এই বাঁধ নির্মাণ ২০১৯ সালে শেষ করে। এতে ৩০৬ কোটি টাকা খরচ হয়। শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বাঁধের পূর্ব পাশে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে চর জেগে ওঠে। আর এই চরে বালুদস্যুরা ড্রেজার বসিয়ে দিন-রাত বালু তুলে বিক্রি করে।
বাঙ্গালী নদীর ব্রিজও হুমকিতে
সারিয়াকান্দির জোড়গাছা এলাকায় বাঙ্গালী নদীর নিচ থেকে বালু উত্তোলন করায় সেখানকার ব্রিজটি হুমকির মুখে পড়েছে। জোরগাছা এলাকার বাসিন্দা ভেলাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রব্বানী টুকু জানান, ব্রিজটির কাছ থেকে বালু তোলার ফলে জোড়গাছা গ্রামসহ চন্দনবাইশা-তরণীহাট পাকা সড়ক দেবে গেছে। ড্রেজার বসিয়ে দিন-রাত বালু তোলা হচ্ছে। এখানে রাজত্ব করছেন ফরহাদ আলী তুষার, ফজলে রাব্বি, বাবুল হোসেন, লুৎফুল বারী বাবু নামের চারজন।
উত্তর ও দক্ষিণ হিন্দুকান্দিতে বাঙ্গালী নদীতে একাধিক শ্যালো মেশিন বসিয়ে রাতের আঁধারে তোলা হচ্ছে বালু। সেখানেও আবাদি জমিসহ রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি বিলীন হচ্ছে। এ ছাড়া দুপচাচিয়ার ধাপেরহাট পাঁচটিকা এলাকায় ড্রেজার দিয়ে বালু তুলছেন সেলিম, শাহজাহান, শফিকুল ও বীরকেদার ইউনিয়ন মেম্বার আসিসুল হক।
আদমদীঘির কুন্দগ্রাম এলাকায়ও শ্যালো মেশিন দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। এতে নদীর পাড় ভাঙছে, দেবে যাচ্ছে আবাদি জমি।
অভিযুক্তদের ভাষ্য
এ কারবারের সঙ্গে জড়িতদের কয়েকজন বলেন, চর থেকে বালু তোলা হলেও এতে বাঁধের ক্ষতি হবে না। বরং বর্ষা মৌসুমে নদী নাব্য ফিরে পাবে। তাঁরা বলেন, বালু তুলে তা সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে সরবরাহ করা হয়।
কার্যাদেশের বেশি বালু তুলেছেন স্বীকার করে সারিয়াকান্দি যুবলীগ সভাপতি আইয়ুব আলী তরফদার জানান, এই কাজটি জেলা যুবলীগের কিছু নেতার পরামর্শে করছেন। কাহালুর আটালিয়ার বালুমহালের নিয়ন্ত্রক ফারুক আহম্মেদ বলেন, কৃষকদের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে বালু তোলা হচ্ছে, এতে ক্ষতির কিছু নেই।
কর্তৃপক্ষ যা বলছে
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হক বলেন, ‘নদী থেকে নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা অবৈধ। যত্রতত্র বালু উত্তোলন বন্ধের ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসককে জানানো হবে।’
সারিয়াকান্দির সহকারী কমিশনার ভূমি এ কে বসাক বলেন, ‘আমি নির্বাহী কর্মকর্তার ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে রয়েছি। বেশি বালু তোলা ও সাব লিজ দেওয়ার কোনো তথ্য আমার জানা নেই। এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সারিয়াকান্দি থানার ওসি রাজেশ কুমার বলেন, ‘আমরা আগে ব্যবস্থা নিতাম। এখন কোনটা বৈধ, কোনটা অবৈধ– এটা নির্ধারণ করা মুশকিল। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসন উদ্যোগ নিলে সহযোগিতা করা হবে।’ তবে পুলিশ এসব বালুমহাল থেকে কোনো টাকাপয়সা নেয় না বলে দাবি করেন তিনি।
মন্তব্য করুন