- সারাদেশ
- তালাবদ্ধ ঘরে ধুঁকে ধুঁকে মারা গেলেন কুলসুম
তালাবদ্ধ ঘরে ধুঁকে ধুঁকে মারা গেলেন কুলসুম

চুয়াডাঙ্গার জীবননগর পৌরসভার কোর্টপাড়ার উচ্ছ্বল কিশোরী ছিলেন উম্মে কুলসুম। বাবা-মা মারা যাওয়ায় মেয়েটি থাকতেন বড় ভাই আবু জাফরের সঙ্গে। জীবননগর শাপলাকলি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় হঠাৎ কুলসুমের মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দেয়। চিকিৎসা না হওয়ায় ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে অসুখ, বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া। সে অবস্থাতেই এলাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন মেয়েটি। এর মধ্যেই তাঁর সরলতার সুযোগ নেয় কেউ। কুলসুমের বয়স যখন ২০, তখন হঠাৎ বাড়ির লোকজন আবিষ্কার করে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা। এ অবস্থায় পাগলামি বাড়তে থাকায় শুরু হয় পরিবারে কুলসুমের বন্দিজীবন।
দোতলা বাড়ির উঠানের এক কোণে গোয়ালঘরের পাশে ময়লা-আবর্জনার স্তূপের মধ্যে কয়েক হাত লম্বা একটি টিনের ঘরে স্থান হয় তাঁর। এক পর্যায়ে ওই আবর্জনার স্তূপের মধ্যেই কুলসুম জন্ম দেন একটি কন্যাসন্তানের। দয়া পরবশ হয়ে মুকুল হোসেন নামে এক প্রতিবেশী পিতৃপরিচয়হীন শিশুটিকে দত্তক নিলেও কুলসুমের বন্দিত্ব শেষ হয়নি। ওই ছোট্ট টিনের খোঁপেই তাঁর কেটে যায় ১০ বছর। কে জানত, সেখানেও তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে এক করুণ মৃত্যু। গত ঈদের সময় বাড়ির সবাই বেড়াতে অন্যত্র গেলেও কুলসুমের কথা কেউ চিন্তা করেনি। ওই টিনের ঘরে তালাবদ্ধ অবস্থায় না খেতে পেয়ে ক্ষুধা-পিপাসায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যান তিনি।
গত সোমবার রাতে আবর্জনার স্তূপের মধ্যে ওই টিনের খোঁপের ভেতর থেকে কুলসুমের গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। স্থানীয় লোকজন তীব্র দুর্গন্ধ পেয়ে উৎস খুঁজতে গিয়ে কুলসুমের লাশ পান। এর পর পুলিশে খবর দেওয়া হয়।
স্থানীয়রা জানান, আবর্জনার স্তূপের মধ্যে পরিত্যক্ত ছোট্ট টিনের ঘরে ১০ বছর ধরে তালাবদ্ধ রাখা হয়েছিল কুলসুমকে। প্রস্রাব-পায়খানাও তাঁকে ওই ঘরেই করতে হতো। তীব্র দুর্গন্ধের জন্য কেউ ঘরের কাছে তেমন যেত না। ইচ্ছা হলে, ভাবি সালমা খাতুন এক বেলা কিছু ভাত ঠেলে দিয়ে আসত টিনের দরজার ফাঁক দিয়ে। কখনও আবার এক-দু’দিন কুলসুমকে খাবার বা পানিও দেওয়া হতো না। এমন অমানবিক আচরণেই কুলসুমের অকাল মৃত্যু হয়েছে।
প্রতিবেশী ভানু খাতুন বলেন, সোমবার সকালে কুলসুমদের বাড়িতে গিয়ে গন্ধের খোঁজ করতে কথা বলেছিলাম ওর ভাবি সালমার সঙ্গে। কুলসুমের কথা জিজ্ঞেস করলে সালমা বলেছিল, সকালেও খাবার দিয়েছে। কিন্তু বিকেলে খবর আসে কুলসুম মারা গেছে।
এ বিষয়ে কুলসুমের ভাই আবু জাফরকে জিজ্ঞেস করলে প্রথমে তিনি দাবি করেন, বোনকে তাঁর পরিবার ঠিকমতোই দেখাশোনা করত। কিন্তু কুলসুম যে সাত-আট দিন আগেই মারা গেছেন, কেন তাঁরা এত দিন জানতে পারেননি– সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কোনো জবাব দিতে পারেননি জাফর।
জীবননগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) স্বপন কুমার দাস বলেন, লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে কীভাবে মেয়েটি মারা গেছেন, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, বাড়ির লোকজনের অবহেলার কারণে অনাহারে মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে। গোয়ালঘরের পাশে পলিথিন ও ময়লা-আবর্জনার স্তূপে ভর্তি টিনের ঘরে যেভাবে মেয়েটিকে তালাবদ্ধ রাখা হয়েছিল, তা খুবই অমানবিক।
জীবননগর থানার ওসি নাসির উদ্দীন মৃধা জানান, প্রতিবেশীরা জানিয়েছে অমানবিক আচরণ করা হতো কুলসুম নামে মানসিক রোগে আক্রান্ত মেয়েটির সঙ্গে। তাঁর পরিবারের কেউ মামলা করতে আগ্রহ দেখায়নি। তবে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পেলে পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।
বিষয় : উম্মে কুলসুম
মন্তব্য করুন