ময়মনসিংহ নগরীর কাচারিঘাট এলাকার ব্রহ্মপুত্র নদ। মাঝখানে হাঁটুসমান পানিতে সাজানো হয়েছে প্রতীকী মঞ্চ। নৌকার পালের মতো সাদা একটি কাপড়ে লেখা আয়োজনের নাম– ‘মৃতের চিৎকার’। প্রধান অতিথি খোদ ব্রহ্মপুত্র। মঞ্চ ঘিরে হাঁটুসমান পানিতে দাঁড়িয়েছেন একদল তরুণ। তাঁদের অনেকের হাতে ব্রহ্মপুত্রের মরণদশাকে উপজীব্য করে নানা প্রতিবাদী স্লোগান। এ সময় করুণ সুরে বেজেছে বাঁশি, গিটার আর তবলার সঙ্গে চলেছে গান, কবিতা। মঞ্চের একটু দূরেই পানির মধ্যে রাখা হয়েছে খাবার টেবিল। তাতে রাখা ভাত ও বিভিন্ন ধরনের ফল; নেই শুধু পানি। আর বিস্ময়ে যেন সবকিছু দেখছে চেয়ারে হেলান দেওয়া অর্ধমৃত ব্রহ্মপুত্র।

ব্রহ্মপুত্র নদ রক্ষায় গতকাল শুক্রবার এমনই ব্যতিক্রমী প্রতিবাদের আয়োজন করেছিলেন কিছু স্থানীয় তরুণ। পরে তাঁদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে কর্মসূচিতে যোগ দেন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনসহ সংস্কৃতিকর্মী ও রাজনৈতিক নেতারা। এ সময় সবার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় স্লোগান– ‘ব্রহ্মপুত্রের চিৎকার শুনতে কি পাও?’

সংস্কৃতিকর্মী শামীম আশরাফ ও তাঁর বন্ধুরা মিলে আয়োজন করেন ‘মৃতের চিৎকার’ নামে ব্রহ্মপুত্র নদ রক্ষার এই ব্যতিক্রমী প্রতিবাদের। আয়োজকরা বলছেন, নদ খননের নামে ব্রহ্মপুত্রকে মেরে ফেলা হচ্ছে। যে প্রহসন চলছে, শিল্পের ভেতর দিয়ে তার প্রতিবাদ করাই ছিল এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য। ২০১৯ সালে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রহ্মপুত্র খনন প্রকল্প শুরু হয়। প্রথমে খনন করা হয় নগরীর কাচারিঘাট এলাকায়। এর পরের বছর থেকে শুষ্ক মৌসুমে নদে চর জাগছে। অথচ খননের আগেও ব্রহ্মপুত্রে কখনও এত কম পানি দেখা যায়নি।

আয়োজনের উদ্যোক্তা শামীম আশরাফ বলেন, ‘শিল্পের মানুষের চিন্তা নিয়ে সমন্বিতভাবে মৃতের চিৎকার কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা জানাতে চাই, ভরা যৌবনের বদলে ব্রহ্মপুত্রে এখন হাঁটুসমান পানি। নদ বাঁচাতে আমাদের এই চিৎকার অনেকের কাছে হয়তো পৌঁছাবে না। তবু আমরা কিছু মানুষ দাঁড়াতে চাই। ব্রহ্মপুত্র খননের নামে যা চলছে, নীরবে দাঁড়িয়ে গান ও কবিতা দিয়েও তার প্রতিবাদ করা যায়। খননের আগে নদের এমন অবস্থা ছিল না। খননের পর হেঁটে নদ পার হওয়া যায়। আমরা এমন ব্রহ্মপুত্র চাই না। আমরা স্রোতস্বিনী ব্রহ্মপুত্র চাই। আমরা হেঁটে পার হতে চাই না, নৌকা দিয়ে পার হতে চাই।’

কবি মোহাম্মদ কামরুল হক বলেন, ‘যখন নতুনভাবে খননকাজ শুরু হয়, তখন আমরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলাম। দুই বছর ধরে প্রতিনিয়ত নদের খননকাজ চলছে এবং প্রতিনিয়তই নদ শুকিয়ে যাচ্ছে। খননের আগেও নদে হাঁটুপানি ছিল, এখনও তাই। প্রতিদিন বালু উত্তোলিত হচ্ছে। কিন্তু একশ্রেণির ব্যবসায়ী বালু নিয়ে ব্যবসা করছে। মূলত নদী খনন নয়; বরং এর আড়ালে বালুর ব্যবসা চলছে। তাই আমরা মৃতের চিৎকার কর্মসূচির মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র রক্ষায় সরকারের কাছে আকুল আবেদন জানাই।’

জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি নুরুজ্জামান খোকন বলেন, ‘জন্মের পর থেকে ব্রহ্মপুত্রে সাঁতার কেটে বড় হয়েছি। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে ব্রহ্মপুত্র উত্তাল রূপ হারিয়েছে। আমরা নদের প্রতি অবিচার করেছি। অনেক মানুষের জীবিকা ছিল, আজ সবই অতীত। যারা সরকারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে খননের কাজ করছে, আমাদের মনে হচ্ছে, তারা ভালোভাবে কাজ করছে না। আজ একটি অহিংস প্রতিবাদ হয়েছে। এর চেয়ে সুন্দর প্রতিবাদ আর হতে পারে না। ব্রহ্মপুত্র বেঁচে থাকা সবার জন্য জরুরি।’

জনউদ্যোগ ময়মনসিংহের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু বলেন, ‘নদ খনন হচ্ছে অপরিকল্পিত এবং অবৈজ্ঞানিকভাবে। এর পেছনে একটি লুটপাটের প্রক্রিয়া থাকতে পারে। ২০২২ সালে জনউদ্যোগের আহ্বানে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এক বৈঠকে ব্রহ্মপুত্র খননের প্রধান প্রকল্প সমন্বয়কারী প্রকৌশলী খন্দকার রাকিবুল ইসলাম বলেছিলেন, ২০২৩ সালের জুন-জুলাইর মধ্যে নদে বার্জ চলবে ঢাকা পর্যন্ত। খননের পর শুকনো মৌসুমে নদের সব জায়গায় ১০ ফুট পানি থাকার কথা। অথচ এখন কোথাও কোথাও ১০ ইঞ্চি পানিও নেই। আমরা মনে করি, রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাটের যে প্রক্রিয়া, এর কৈফিয়ত জনগণের কাছে দিতে হবে। তা আদায় করতে জনগণের পক্ষ থেকে আমরা আন্দোলনের ডাক দেব।

জানা গেছে, দখল, দূষণ আর পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদের নাব্য ফিরিয়ে আনতে ২০১৯ সালের শেষের দিকে শুরু হয় খনন। প্রকল্পটি আগামী ২০২৪ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। যার মধ্যে প্রথম দুই বছর ড্রেজিং এবং পরবর্তী তিন বছর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হওয়ার কথা ছিল। প্রকল্প অনুযায়ী খননের পর যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থল জামালপুরের কুলকান্দি থেকে কিশোরগঞ্জের টোক পর্যন্ত নদ ৩০০ ফিট প্রশস্ত ও শুষ্ক মৌসুমে ১০ ফুট গভীর থাকবে বলে জানানো হয়। এরই মধ্যে নদের ২২৭ কিলোমিটার খনন করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এর পরও নদের উল্লিখিত এলাকায় পানির একই অবস্থা বিরাজ করছে, যা নিয়ে ক্ষুব্ধ নদপাড়ের মানুষ।

নদ খননের সাবেক প্রধান প্রকল্প সমন্বয়কারী ও বিআইডব্লিউটিএর বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী খন্দকার রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্পের টাকা ছাড় না হওয়ায় খননকাজ চলছে ধীর গতিতে। ময়মনসিংহ অংশে প্রায় ৫০ শতাংশ কাজ হয়েছে। জামালপুর অংশে কাজ শুরু করা যায়নি। আগামী জুলাই মাসে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা পর্যন্ত বার্জ চলবে। উদ্বোধনের জন্য মন্ত্রীর শিডিউল চাওয়া হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, খননকৃত মাটি ফেলার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। সে কারণে ড্রেজিংও করা যাচ্ছে না। এই নদ ভরাট হয়ে যায়, তাই সব সময় নজরদারিতে রাখতে হবে।’ এদিকে প্রতিবাদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এত প্রতিবাদ করে লাভ কী? তারা তো সরকারের কাছ থেকে টাকা আনতে পারে না।’