ভোটের আগে টানা হয়নি আওয়ামী লীগের ঘরোয়া বিবাদের লাগাম, ত্যাগী নেতাদেরও করা হয়নি মূল্যায়ন। এ কারণে রংপুর সিটিতে ভোটের ফল সুখকর হয়নি। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে খোয়াতে হয়েছিল জামানত। সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচন ঘিরে তেমনই শঙ্কার মেঘ। সেখানকার তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর মনে ‘রংপুরভীতি’। ভেতরে ভেতরে মনোনয়নবঞ্চিতদের চাপা ক্ষোভ আর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল হানিফ কুটু ভোটের মাঠে নামায় নৌকা প্রার্থীর মসৃণ পথ বন্ধুর হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া ভোটের হিসাব-নিকাশে জাতীয় পার্টির প্রার্থীও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

খোদ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকও সিলেটে দলাদলির ত্রিশঙ্কু অবস্থা দেখে বলেছেন, ‘রংপুরের মতো পরিস্থিতি যেন না হয়।’ তবে সিটি নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ এবং নৌকার বিজয়ে আশাবাদী বলে জানিয়েছেন দলীয় নেতারা। আগামী ২১ জুন ইভিএমে সিলেট সিটির ভোট হবে।

সিলেট সিটির ভোটে লড়তে চেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, নগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ, সহসভাপতি আবদুল খালিক, সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ টি এম এ হাসান জেবুল, আজাদুর রহমান আজাদ, সদস্য প্রিন্স সদরুজ্জামান চৌধুরী এবং ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য মো. মাহি উদ্দিন আহমদ সেলিম। এ জন্য তাঁরা নগরজুড়ে প্রচারণাও চালান।

হঠাৎ বদলে যায় দৃশ্যপট। গত ২২ জানুয়ারি লন্ডন থেকে সিলেট আসেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। সিলেট আসার পর তাঁকে দেওয়া হয় বিপুল সংবর্ধনা। বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমানসহ অনেকেই।

আনোয়ারুজ্জামান সিলেট এসেই দল থেকে তাঁকে ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়া হয়েছে বলে নগরজুড়ে প্রচার চালান। এমনকি তাঁর ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে যায় নগরী। এমন প্রচারণায় সিলেট আওয়ামী লীগে দেখা দেয় বিভক্তি। একপর্যায়ে নগর আওয়ামী লীগ বিবৃতি দিয়ে বলে, এ ধরনের প্রচারে কেউ যেন বিভ্রান্ত না হয়। গত ২৫ এপ্রিল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভায় আনোয়ারুজ্জামানকে দলের প্রার্থী করা হলেও দেখা যায়নি মনোনয়নবঞ্চিত কাউকে। পরে অবশ্য কেউ কেউ তাঁর সঙ্গে প্রচারে অংশ নেন।

সিলেটের ভোট নিয়ে পদধারী নেতারা শঙ্কিত না হলেও তৃণমূলে রয়েছে নানা গুঞ্জন। কেউ কেউ বলছেন, মনোনয়নবঞ্চিতদের প্রার্থী হচ্ছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল হানিফ কুটু। তাঁকে তলে তলে মনোনয়নবঞ্চিত অনেক নেতা উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। কয়েকজন নেতা জানান, দলের বিভক্তি জোড়া লাগানো না গেলে রংপুরের মতই হবে সিলেটের পরিস্থিতি।

তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, গত নির্বাচনে কামরানের পরাজয়ের পেছনের মূল কারণ ছিল দলের কোন্দল। নির্বাচনের দিন নৌকার কার্ড ঝুলিয়ে ধানের শীষে ভোট দিয়ে বাক্স ভরে দিয়েছিল মনোনয়নবঞ্চিত পক্ষটি। এবারও এমনটা হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আনোয়ারুজ্জামানকে যেভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তা কেউ মানতে পারছেন না। যাঁরা দীর্ঘদিন রাজনীতি করে সিলেটে একটা ‘পজিশন’ তৈরি করেছিলেন, তাঁরা এখন চুপসে গেছেন। তাঁদের অনেকের সঙ্গে রয়েছে তৃণমূলে সম্পৃক্ততা।

এদিকে হঠাৎ করেই গত বুধবার মেয়র পদে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে আলোচনায় আসেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মোহাম্মদ আবদুল হানিফ কুটু। আশি ও নব্বইয়ের দশকে সিলেটের ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন কুটু। এ ছাড়া যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি। এখন তিনি দলের কোনো পদে নেই।

কুটু ১৯৮৬-৮৭ সালে ছাত্রলীগের ব্যানারে এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ছাত্র সংসদে নির্বাচন করে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯১-৯২ সালে নির্বাচন করে তিনি সিলেট সরকারি ডিগ্রি কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

এ ব্যাপারে আবদুল হানিফ কুটু বলেন, ‘আমি নির্বাচন করব, এটি কোনোদিন ভাবিনি। আমার ভাবনায়ও নির্বাচন নেই। আমার প্রতিবাদ দলের বিরুদ্ধে নয়, দলের একটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে।’ তিনি বলেন, ‘সিলেটে ৮ থেকে ১০ প্রার্থী প্রচারণায় ছিলেন। ভেবেছিলাম, যাঁরা প্রচারণা চালিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে থেকেই প্রার্থী দেওয়া হবে। হঠাৎ দেখি পটপরিবর্তন। যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয়, তাঁদের কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। এটি আমার মনে পীড়া দিয়েছে। এ কারণেই প্রার্থী হয়েছি। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে প্রার্থী থেকে এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদ অব্যাহত রাখব।’

জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য লাঙ্গলের প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল বলেন, সিলেট ছিল একসময় জাতীয় পার্টির ঘাঁটি। এরশাদের দুর্গ ছিল। বিগত সময়ে সিলেট যে উন্নয়ন হয়েছে, এরশাদের ভূমিকা কোনোভাবেই ছোট করে দেখা যাবে না। এসব কারণে লাঙ্গলের বিজয় নিশ্চিত।

এ ব্যাপারে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন বলেন, ‘দলে বিভিন্ন ধরনের লোক আছেন। সবার মতকে ধরে নিলে কোনো কাজ করা যায় না। আমাদের মনোনয়ন বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সিলেটে নৌকার কাণ্ডারি আনোয়ারুজ্জামান। আমরা সে পথেই হাঁটছি। আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত। দলীয় কোন্দল সমাধান হয়েছে কিনা এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মনোনয়নবঞ্চিতরা আমাদের প্রার্থীর পাশে আছেন।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সমর্থনে জেলা ও নগর আওয়ামী লীগের কর্মিসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘দলে খন্দকার মোশতাকের অনুসারী যেমন রয়েছে, তেমনি মুজিব আদর্শের লড়াকু ও ত্যাগী কর্মীও রয়েছেন। মোশতাক বাহিনীর কারণেই বিগত দিনে এই নগরের অভিভাবক বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে হারতে হয়েছে। এবার সেই সুযোগের পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না আওয়ামী লীগ।’ দলের প্রতিটি ওয়ার্ডে সভাপতি ও সম্পাদকের ভোটকেন্দ্রগুলোতে সজাগ দৃষ্টি থাকার নির্দেশ দেন এই নেতা। তিনি বলেন, ‘এমন কোনো কর্মকাণ্ড করবেন না, যাতে সিলেটে আমাদের রংপুরের পরিণতি ভোগ করতে হয়।’