- সারাদেশ
- বেহুলা সুন্দরীর চাঁদের মেলা অপেক্ষা রানীরহাটের
চলনবিলে বৈশাখী মেলা
বেহুলা সুন্দরীর চাঁদের মেলা অপেক্ষা রানীরহাটের

তাড়াশের চলনবিলের গুড়মা মেলায় চরকি - সমকাল
দেশের চিরায়ত লোকজ সংস্কৃতির ধারক-বাহক বৈশাখী মেলা। মেলাকে কেন্দ্র করে বিস্তীর্ণ চলনবিল অঞ্চলের মানুষ মেতে ওঠেন আনন্দ-উচ্ছ্বাসে। চলে নানা অনুষ্ঠান, বিভিন্ন পণ্যের বিকিকিনি। মেলা বসার দিনটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চান্দ্রক্ষণ বা তারিখের ওপর নির্ভরশীল। এভাবে বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসজুড়ে একটির পর একটি মেলা যেন সত্যিকার অর্থেই মাতিয়ে রাখে গোটা চলনবিল অঞ্চল। তেমনই ঐতিহ্যবাহী বেহুলা সুন্দরীর চাঁদের মেলা গত শুক্রবার শুরু হয়েছে তাড়াশের বিনসাড়া গ্রামে। তিন দিনব্যাপী এই মেলায় দূরদূরান্ত থেকে এসে যোগ দিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। মুড়িমুড়কি, বাতাসা, মিষ্টি, মাটি-বাঁশ ও বেতের তৈরি তৈজসপত্র, খেলনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পণ্যের চলছে জমজমাট বেচাকেনা। আগতদের আনন্দ দিচ্ছে নাগরদোলা, পুতুলনাচ, জাদু প্রদর্শনীসহ নানা আয়োজন। আজ রোববার এই মেলা শেষ হলেও উৎসব শেষ হচ্ছে না। আগামী ১৪ মে শুরু হবে আরেক ঐতিহ্যবাহী রানীরহাটের মেলা।
প্রাচীন বাংলার বিখ্যাত মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান চরিত্র এবং চাঁদ সওদাগরের ছেলে লখিন্দরের স্ত্রী ছিলেন বেহুলা। জনশ্রুতি আছে, বেহুলার বাড়ি ছিল সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বিনসাড়া গ্রামে। আজও বিনসাড়া গ্রামে গেলে দেখা যায়, বেহুলার বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া একটি বড় কূপ। যা বেহুলার কূপ নামেও পরিচিত। ঐতিহাসিকভাবে এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও স্থানীয় মানুষ তা বিশ্বাস করেন। বেহুলার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে প্রতি বৈশাখী পূর্ণিমায় বিনসাড়া গ্রামে বসে তিন দিনের বেহুলা সুন্দরীর চাঁদের মেলা।
চলনবিলের বড় মেলার বেশিরভাগই সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, পাবনার চাটমোহর, নাটোরের সিংড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় হয়। এসব মেলার নামকরণ স্থানের নামেই হয়েছে। মূলত চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত চলনবিল এলাকার মেলাগুলো নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ম মেনে বছরের পর বছর আয়োজন হয়ে আসছে। চাটমোহরের প্রায় ৮০০ বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখা বোথরের চৈত্রসংক্রান্তির ‘চড়ক মেলা’ এবং মূলগ্রাম ইউনিয়নের শাহপুরের প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো ‘শাহ চেতন মেলা’ বসে বৈশাখের প্রতি বৃহস্পতিবার। এ ছাড়া তাড়াশে মাঘের পঞ্চমী তিথিতে বসে প্রায় ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘দইয়ের মেলা’। চৈত্রের পূর্ণিমার রাতে তাড়াশের ‘বারুহাঁসের ভাদাই মেলা’ এবং বৈশাখের তৃতীয় মঙ্গলবার বসা ‘গুড়মা মেলা’ও অন্যতম।
জ্যৈষ্ঠের শুরুতে অনুষ্ঠিত হবে গোনতা মেলা, ছোট গুড়মা মেলা, গুড়পিপুলের নিশানের মেলা, সিংড়ার তিশিখালী মেলা, নিশ্চিতপুর মেলা, বিয়াস মেলা, সিংড়ার দহ ধুলাউড়ি মেলা। এর মধ্যে সিংড়ার নিশ্চিতপুর মেলায় ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার রেওয়াজ শতবর্ষের।
এসব মেলা ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন আঞ্চলিক রেওয়াজ। যেমন– মেলার আগেই কাছে বা দূরদূরান্তের গ্রামে, এমনকি শহরে থাকা মেয়ে জামাইকে নাইওর আনার তাগাদা দেওয়া হয়। পাশাপাশি আত্মীয়দের দাওয়াত বা নিমন্ত্রণ করা হয় বাড়িতে। মেলার আগেই এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়ি আত্মীয়স্বজনে ভরে ওঠে। এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে মেলার আমেজ। আবার শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে শাশুড়ির হাত দিয়ে জামাইকে মেলার ‘পরবি’ (নগদ টাকা) এবং মেলা শেষে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় নতুন পোশাক, বিশেষ করে দামি লুঙ্গি উপহার দেওয়ার চল এখনও রয়েছে। জামাইদেরও এসব মেলায় বড় অঙ্কের খরচ হয়ে থাকে। যেমন– মেলা থেকে হাঁড়িভর্তি মিষ্টি এবং বড় মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যেতে হয়। সে ক্ষেত্রে অনেক জামাই শ্বশুরের নাম রাখতে প্রতিযোগিতা করে মেলার সবচেয়ে বড় মাছ কিনে আনেন। এ ছাড়া শ্যালক-শ্যালিকাদের মেলার পরবি দেওয়া বা অন্য উপহারের আবদার মেটানোও জামাইদের অতি পুরোনো রেওয়াজ।
বিলপাড়ের প্রতিটি বৈশাখী মেলায় চিনি দিয়ে তৈরি সুস্বাদু হাতি, ঘোড়া, হরিণ, পাখি আকৃতির ছাঁচ, খাগড়াই, বাতাসা, কদমা প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয়। আরও রয়েছে বাহারি মিষ্টি রসগোল্লা, চমচম, ছানার জিলাপি, রসমালাই, শাহি ক্ষিরসাস। এলাকার ঘোষদের নানা নামের ও স্বাদের দই কেনাবেচা চলে মূল মেলার আগের দিন থেকেই। এ ছাড়া মেলায় শত শত মণ ঝুরি বিক্রি হয়। এসব ঝুরির নানা নাম রয়েছে। যেমন– সাদা ঝুরি, হলুদ ঝুরি, লাল ঝুরি, নয়ন ঝুরি; যা বিশেষ কায়দায় তৈরি। ঝুরি তৈরিতে ঐতিহ্য রয়েছে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ ও সলঙ্গা এলাকার ইচলাদিগড়, ঘুড়কা, ভুইয়াগাঁতীসহ কয়েকটি গ্রামের।
মন্তব্য করুন