নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন, পাবলিক হল কমপ্লেক্স নির্মাণসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) মেয়র নির্বাচিত হন তালুকদার আবদুল খালেক। মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার আগেই জলাবদ্ধতা নিরসনে ৮২৩ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে চমক দেখান তিনি। পরে অনুমোদন হয় ১ হাজার ৪৯২ কোটি টাকার আরও তিনটি প্রকল্প। তবে মেয়াদ শেষ হতে চললেও প্রতিশ্রুত প্রকল্পগুলোর অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি। এর মধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের ৫৩টি ড্রেনের কাজ এখনও শুরু করা যায়নি। ময়ূর নদ খননসহ ১০৪টি কাজ রয়েছে মাঝপথে। পাবলিক হল কমপ্লেক্সসহ অবকাঠামো উন্নয়নে নেওয়া প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদন এখনও মেলেনি। কবরস্থান ও শ্মশানের উন্নয়নকাজও শুরু হয়নি।

তবে গত সাড়ে চার বছরে নগরীর সাড়ে চার শতাধিক সড়ক সংস্কার করা হয়েছে। ওয়াসার খুঁড়ে রাখা সড়ক বাদে নগরীর অধিকাংশ সড়কই এখন চলাচল উপযোগী। প্রধান সড়কের দু’পাশের প্রশস্ত ফুটপাত নগরবাসীকে এনে দিয়েছে স্বস্তি।

কেসিসির কর্মকর্তারা জানান, গত সাড়ে চার বছরে খুলনা সিটি করপোরেশনে রেকর্ড পরিমাণ ২ হাজার ৩১৪ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। তবে করোনার কারণে দুই বছর বন্ধ রাখতে হয়েছে কাজ। নির্মাণসামগ্রীর দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার ফলে কাজের গতি কমে যায়। যার প্রভাব পড়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে।

কেসিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১৫ মে খুলনা সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের আগে ‘জলাবদ্ধতামুক্ত আধুনিক পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ে তোলা’ শিরোনামে ৩১ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছিলেন তালুকদার আবদুল খালেক। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে নজর দেন তিনি। তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের ৭ দিন আগে একনেকে অনুমোদন হয় ‘খুলনা শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন (প্রথম পর্যায়)’ প্রকল্প। ২৫ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব গ্রহণের দিন ৮২৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে খুলনা মহানগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়।

এদিকে, খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১২ জুন। এবারও মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান মেয়র ও খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেক।

অর্ধেক কাজই শেষ হয়নি প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর থেকে জানা গেছে, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় ময়ূর নদসহ ৮টি খাল খনন, বিভিন্ন সড়কের দুই পাশে ১৯০ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য স্লুইসগেট সংস্কার ও পাম্প স্টেশন নির্মাণের কথা ছিল। ২২৫টি প্যাকেজে ছোট ছোট করে এসব কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল।

সূত্র জানায়, প্রথমে প্রকল্পের মেয়াদ ছিল চার বছর। তবে অনেক কাজ শুরু না হওয়ায় ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। তবু অনেক কাজ শুরু করা যায়নি। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত মার্চ পর্যন্ত মাত্র ৯১ কোটি টাকার ৪৯টি প্যাকেজের কাজ শেষ হয়েছে। দরপত্র প্রক্রিয়াসহ ১০৪টি প্যাকেজের কাজ চলমান। এতে খরচ হবে ৪৭৫ কোটি টাকা। ৫৩টি প্যাকেজের কাজ এখনও শুরু হয়নি।

কেসিসির গত মার্চের প্রতিবেদনে প্রকল্পের অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ৫৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। খরচ দেখানো হয়েছে ৩৪২ কোটি টাকা। প্রকৃত অর্থে এত টাকার বিল পরিশোধ হয়নি।

প্রকল্প এলাকা ঘুরে ও পরামর্শক সংস্থার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ময়ূর নদসহ খাল খননের অধিকাংশ কাজ রয়েছে মাঝপথে। প্রায় ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ময়ূর নদের খনন হয়েছে মাত্র ৯০০ মিটার এলাকা; ক্ষুদে খালের ১ কিলোমিটার, হরিণটানা খালের ৮৫০ মিটার, ট্রাক টার্মিনাল খালের মাত্র ৪৭৫ মিটার খনন হয়েছে। শুধু নারকেলবাড়িয়া খালের মূল খনন শেষ হলেও অন্য কাজ বাকি। তবে ক্ষেত্রখালে ড্রেন নির্মাণ শেষ হয়েছে। বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশনের জন্য পাম্প হাউস নির্মাণের কাজ শুরু হয়নি। এই কাজের জন্য প্রকল্প সংশোধন করা হচ্ছে।

অন্যান্য প্রতিশ্রুতির কাজও শুরু হয়নি

মেয়রের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ৬ নম্বরে ছিল কবরস্থান ও শ্মশানঘাটের উন্নয়ন। এ জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ‘কভিড-১৯ রেসপন্স ও রিকভারি’ প্রকল্পের আওতায় ৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর আওতায় নগরীর সব কবরস্থান ও শ্মশান আধুনিকায়নের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। তবে একটি কাজও শুরু হয়নি।

মেয়রের প্রথম ও দ্বিতীয় নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি ছিল নগরীর শিববাড়ী মোড়ে বহুতলবিশিষ্ট পাবলিক হল কমপ্লেক্স (সিটি সেন্টার) গড়ে তোলা। এ জন্য আলাদা প্রকল্পও নেওয়া হয়। তবে তার অনুমোদন মেলেনি। পরে সিটি সেন্টারসহ নগরীর বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে দেড় হাজার কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পটি রয়েছে এখন পরিকল্পনা কমিশনে।

গতি শুধু সড়ক সংস্কারকাজে

২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর একনেকে অনুমোদন হয় ‘কেসিসির গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা উন্নয়ন ও পুনর্বাসন’ প্রকল্প। ৬০৭ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পে ছোট-বড় ৫৭১টি সড়ক সংস্কার ও মোড় প্রশস্তকরণ করার কথা ছিল।

প্রকল্প অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৪১৩টি সড়কের কাজ শেষ হয়েছে। ১১৯টি সড়কের কাজ বর্তমানে চলমান। ওয়াসা খুঁড়ে রাখায় গুরুত্বপূর্ণ ১২ সড়কে কাজ করা যাচ্ছে না। ৩৯ সড়কের এখনও দরপত্র আহ্বান করা হয়নি।

বাকি দুই প্রকল্পও গতিহীন

কেসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নে ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর একনেকে অনুমোদন হয় ‘কেসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন’ প্রকল্প। ৩৯৩ কোটি টাকার এ প্রকল্পে আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়, জমি অধিগ্রহণ করে একাধিক এসটিএস নির্মাণ, আধুনিক গ্যারেজসহ অবকাঠামোর কাজ রয়েছে। তবে জমি অধিগ্রহণ করতেই গত আড়াই বছর কেটে গেছে। সম্প্রতি কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনার দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। গত মার্চ পর্যন্ত এ প্রকল্পে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। জমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনকে ১৩৭ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এতেই প্রকল্পের অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ।

গত ১৭ জানুয়ারি একনেকে অনুমোদন হয়েছে ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলায় খুলনা শহর এলাকা উন্নয়ন ফেজ-২’ প্রকল্প। এতে খরচ হবে ৪৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জার্মান উন্নয়ন ব্যাংক অনুদান দেবে ৩১২ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের কাজও শুরু হয়নি।

যা বলছে কেসিসি

এ বিষয়ে কেসিসির ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মশিউজ্জামান খান সমকালকে বলেন, প্রকল্পের কাজ শেষ করার মূল বাধা ছিল করোনা সংক্রমণ। ওই সময় দুই বছর কাজ প্রায় বন্ধ ছিল। এর পর নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ঠিকাদাররা দরপত্রে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিলেন। পাম্প স্টেশনের কাজে খরচ অনেক বেড়েছে। এ জন্য প্রকল্প সংশোধন করতে হচ্ছে। এ ছাড়া প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগ, নকশা তৈরিতে দুই বছর সময় চলে গেছে। তবে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে এখন গতি ফিরেছে। খুব দ্রুত এ কাজ শেষ হবে। তিনি বলেন, কবরস্থান ও শ্মশান সংস্কারের দরপত্র প্রক্রিয়া প্রায় শেষ। আগামী মাসে এ কাজ শুরু হবে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক কেসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবদুল আজিজ সমকালকে বলেন, জমি অধিগ্রহণে দীর্ঘ সময় লাগছে। অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হলে প্রকল্পের কাজ শেষ হতে বেশি সময় লাগবে না। নদী খননের জন্য ভাসমান এক্সক্যাভেটরসহ বেশ কিছু যন্ত্র আনার প্রক্রিয়া চলছে।

সার্বিক বিষয় নিয়ে সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক বলেন, গত সাড়ে ৪ বছরে কেসিসিতে যে উন্নয়ন হয়েছে; ৩৩ বছরেও তা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী খুলনার জন্য আড়াই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। বরাদ্দ যখন হয়েছে; কাজ হবেই। তিনি বলেন, করোনার কারণে দুই বছর কাজ বন্ধ ছিল। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় ঠিকাদার পাওয়া যায়নি। এসব সমস্যা নিয়েই উন্নয়ন কাজ চলছে। নির্ধারিত সময়েই সব কাজ শেষ হবে।

মেয়র বলেন, প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। আগামীতে নির্বাচিত হলে সব কাজ শেষ করব। প্রতিশ্রুতি দিয়েছি বলেই ৫ বছরের কাজ ৩ বছরে শেষ করতে হবে– এমন কোনো কথা নেই। কাজ চলছে। নির্ধারিত সময়েই সব কাজ শেষ হবে।