- সারাদেশ
- প্রবল জলোচ্ছ্বাস পাহাড় ধসের ভয়
প্রবল জলোচ্ছ্বাস পাহাড় ধসের ভয়

প্রতীকী ছবি
টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে এক কিলোমিটার উত্তরে জালিয়াপাড়া। সেখানেই কথা হয় শতবর্ষী জেলে হরিশংকর জলদাসের সঙ্গে। কাইয়ুমের দোকানে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন তিনি। এর ঠিক ১০ হাত দূরে নাফ নদী। জোয়ারের গর্জনে ঠিকমতো শোনা যাচ্ছিল না হরিশংকরের কথা। ঘূর্ণিঝড় মোকার প্রভাবে ১০ নম্বর মহা-বিপৎসংকেতেও নির্বিকার হরিশংকর। বললেন, ‘কোথায় যাব, মরলে এখানে, বাঁচলেও এখানে।’ যে দোকানে বসে শনিবার দুপুর ২টায় এমন কথা বলছেন হরিশংকর, সেই দোকানের ৩০ গজের মধ্যেই আছে একটি আশ্রয়কেন্দ্র। হরিশংকরের মতো এ রকম আরও বহু মানুষের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে ঘোর আপত্তি।
তবে শাহপরীর দ্বীপ উত্তর জালিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে একটি আশ্রয়কেন্দ্র এ দ্বীপে থাকলও সেটিও ঝুঁকিতে। নাফ নদীর ঢেউ একের পর এক আছড়ে পড়ছে জীবন রক্ষার এ ভবনে। বেড়িবাঁধের নিচে নদীতীরে গড়ে ওঠা এই আশ্রয়কেন্দ্র ভরসা রাখতে পারছিলেন না আট শতাধিক জেলে পরিবারের কেউই।
শাহপরীর দ্বীপের মতো এমন চিত্র দেখা গেছে সাগর আর পাহাড়ঘেঁষা টেকনাফের বাঁকে-বাঁকে। টেকনাফের দক্ষিণে বড় বিপদের নাম সাগর। আর উত্তরে বড় আপদের নাম পাহাড়। বৃষ্টি যদি একটু বাড়ে, এখানে হবে পাহাড়ধস। সেই ধসেও যেতে পারে মানুষের প্রাণ। এই পরিস্থিতিতে কক্সবাজার উপকূলের লাখো মানুষের জীবন এখন হুমকিতে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প আছে টেকনাফের দক্ষিণে, আর সাগর আছে উত্তরে। পূর্বে আছে নাফ নদী। পশ্চিমে পাহাড়। দক্ষিণে শক্ত কোনো বেড়িবাঁধ না থাকায় এখানকার লাখো বাসিন্দা আছেন দুশ্চিন্তায়। টেকনাফ পৌরসভা চত্বর থেকে ২০০ গজ সামনে এগোলে পড়ে কায়ুকখালী ব্রিজ।
সেই ব্রিজের দু’পাশে গতকাল বাঁধা ছিল শতাধিক ট্রলার, নৌকা ও স্পিডবোট। সেখান থেকে আরও ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ শিশু পার্ক। সাগর থেকে ১০০ গজ দূরে থাকা এই শিশু পার্কে গতকাল দুপুর ১২টায় ছিল পিনপতন নীরবতা। সমুদ্রের গর্জনে এ সময় তটস্থ থাকতে দেখা যায় টেকনাফ সৈকত এলাকার মানুষকে। নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলারকে ডাঙায় ওঠাতে দেখা গেছে জেলেদের। টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের দু’পাশে শতাধিক নৌকা সারিবদ্ধভাবে বেঁধে রেখেছেন জেলেরা। জলের নৌকা এভাবে সড়কে বাঁধার অভিজ্ঞতা প্রথম বলে মন্তব্য করলেন জেলে জীবন দাস। তিনি বলেন, ‘অনেক ঘূর্ণিঝড় দেখেছি। কিন্তু সাগরকে এমন রূপে দেখিনি কখনও। চাপা এক আবহাওয়া দেখছি। এতে মনে হচ্ছে, বড় কোনো দুর্যোগ আসবে এবার।’ জীবন জলদাসের মতো একই মত তাঁর ছেলে পরিমলের। তাঁর বয়স বেশি না। ৩০ থেকে ৩৫ এর কোঠায় হবে। কিন্তু তিনিও বলছেন এবারের ঘূর্ণিঝড়ে খুব ভয় পাচ্ছেন তাঁরা। কারণ, দক্ষিণে নেই শক্ত কোনো বেড়িবাঁধ। সামান্য ঢলে এখানে বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাস হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ‘কক্সবাজারে ৬৩৬ আশ্রয়কেন্দ্রে উপকূলের ১ লাখ ৩৬ হাজার মানুষকে নিয়ে আসা হয়েছে।’ ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশ সদস্যরা প্রস্তুত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপে তিনটি সাইক্লোন শেল্টারসহ ৩৭টি হোটেল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তাতে সাত হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নিতে পারবেন।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভূমিধসের শঙ্কা
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোকার কারণে এখন ১০ নম্বর মহা-বিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। মহা-বিপৎসংকেত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আট লাখ রোহিঙ্গার মধ্যেও আতঙ্ক বাড়ছে। পাহাড় কেটে গড়ে উঠা এই জনপদে তৈরি হয়েছে ভূমিধসের শঙ্কা। যারা পাহাড়ের পাদদেশে বাস করছে, তাদের নিরাপদ স্থান স্কুল, মসজিদ ও মাদ্রাসায় আশ্রয় নিতে মাইকিং করা হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে টানানো হয়েছে লালপতাকা। টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্প-২৬ এর ‘ই’ ব্লকের মাঝি (নেতা) মো. আয়াছ জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকার খবর জেনে আতঙ্কে আছেন তাঁরা। বসতঘরগুলো দুর্বল ও পুরোনো হয়ে গেছে। আবার এগুলো গড়েও উঠেছে পাহাড় কেটে। বৃষ্টি যদি বাড়ে, হবে ভূমিধস। ঘটবে প্রাণহানির ঘটনাও। ভূমিধস হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা রোহিঙ্গাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। অনেককে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শামছুদ্দৌজা নয়ন বলেন, কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সব রোহিঙ্গা শিবিরের লোকজনকে সতর্ক করা হয়েছে। মাইকিং করে ক্যাম্পের দুর্বল ঘরগুলো বাঁশ ও রশি দিয়ে মজবুত করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি পাহাড়ে অতি ঝুঁকিপূর্ণদের চিহ্নিত করে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্ততি চলছে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক দল গঠন করা হয়েছে। টেকনাফের জাদিমুড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি বজলুর রহমান বলেন, ‘আমার ক্যাম্পে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বাস। এর মধ্য বেশিরভাগই শিশু-নারী। যাদের অধিকাংশের পাহাড়ের পাদদেশে বাস। বৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মাঝে ভূমিধসের ভয় বাড়ছে।’
সেন্টমার্টিনে গুমোট আকাশ
সাগর উত্তাল। সেন্টমার্টিন দ্বীপের আকাশ গুমোট। ঘূর্ণিঝড়ের আগে পরিস্থিতি দেখতে দ্বীপের পূর্বদিকের জেটিতে ভিড় করছে লোকজন। শনিবার বিকেলে সেই জেটিতে দাঁড়িয়ে আবদুল মালেক ফোনে বলেন, ‘৩০ বছরের এই বয়সে তিন-চারটি ঘূর্ণিঝড় দেখেছি। তবে সেন্টমার্টিনের এতটা রুদ্ররূপ দেখিনি কখনও। ভয়ে তিন থেকে চার হাজার মানুষ এলাকা ছেড়ে টেকনাফে চলে গেছে। আতঙ্কে আছে বাকি আট হাজার মানুষ। হোটেল-মোটেলসহ বিভিন্ন উঁচু ভবনে তারা আশ্রয় নিয়েছে। এদিকে যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেছে এই দ্বীপের সঙ্গে। এখন আর কেউ চাইলেও এই দ্বীপ ছাড়তে পারবে না।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান জানান, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণপাড়া, হলবনিয়া, পুঁতকাটাবনিয়া, ডেইলপাড়াসহ ছয়টি গ্রামে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার মানুষের বাস। এই দ্বীপের সর্বদক্ষিণের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কোথাও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নেই। নেই পাকা ভবনের হোটেল রিসোর্টও। এখানকার মানুষদের তাই আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার তোড়জোড় চলছে। বৈরী পরিবেশের কারণে সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রায় সব বাজার বন্ধ আছে।
‘জীবন বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে এসেছি’
কক্সবাজারে সাগর পাড়ের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা শুক্রবার গভীর রাত থেকে বিভিন্ন স্কুল, মাদ্রাসার আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিচ্ছে। শনিবার দুপুরে পৌর প্রিপ্রারেটরি উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, পুরো স্কুলে অসংখ্য নারী-পুরুষ ও শিশু রয়েছে। স্কুলের প্রতিটি রুম ও বারান্দায় ঘুমাচ্ছে। কয়েক জোড়া ব্যবহারের কাপড় নিয়ে চলে এসেছেন বলে জানান আবদুর রহমান। অনেকে গৃহপালিত পশুপাখিও সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা সলিমা বেগম বলেন, জীবন বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে এসেছি। তবে সকাল থেকে খাবার ও পানীয় না পাওয়ায় একটু কষ্ট হচ্ছে। এমন কথা আশ্রয় নেওয়া অধিকাংশ ব্যক্তিরই।
মন্তব্য করুন