বাংলা চলচ্চিত্রের নন্দিত অভিনেতা ফারুক। সিনেমা পর্দায় প্রতিবাদী গ্রামীণ তারুণ্যের সপ্রতিভ উপস্থাপনায় ফারুক বিপুলভাবে জনপ্রিয়। কালজয়ী এই অভিনেতা ১৫ মে প্রয়াত হন। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন তিন গুণী পরিচালক...

মতিন রহমান

আমার শিক্ষক, মামা ফাইজুর রহমান চলচ্চিত্রে স্বর্ণালি সময়ের পরিচালক ছিলেন। শাবানা, ববিতা, ফারুক থেকে শুরু করে সেই সময়ের সব তারকা শিল্পী কাজ করেছেন তাঁর সিনেমায়। সে সুবাদে আমারও তারকা শিল্পীদের সঙ্গে কাজের সুযোগ হয়েছে। এ কারণে সব অভিনয়শিল্পীর সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। অভিনেতা ফারুকের সঙ্গেও সুসম্পর্ক হয়। আমার প্রথম সিনেমা ‘লাল কাজল’-এ অভিনয় করেছেন ফারুক ভাই। সেই সিনেমার পাঁচটি দৃশ্য ছিল তাঁর। অতিথি চরিত্র। ওই সময়ে তাঁর খুব নামডাক। এ মাপের প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা কোনো পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের জন্য রাজি হতেন না। এটি ছিল তাঁর উদারতা। তিনি সিনিয়র নির্মাতাদের যেমন সম্মান করতেন, পাশাপাশি নবীন কোনো নির্মাতাকেও কাজের সুযোগ দিতেন। যাঁদের মধ্যে একটু সম্ভাবনা দেখতে পেতেন, তাঁদের সিনেমায় রাজি হতেন। ‘লাল কাজল’ সিনেমায় বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন তিনি। ‘লাল কাজল’ সিনেমার একটি দৃশ্যের কথা খুব মনে পড়ে। ফারুক ভাই ফাঁসিতে ঝুলবেন। তখন শুটিংয়ে বড় আয়োজন ছিল না। গলায় রশি পেঁচিয়ে, কোমরে বেল্ট বেঁধে তাঁকে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। হঠাৎ শরীরের ওজনে গাছের ডাল ভেঙে মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। একটু পর উঠে শুটিং করতে পারবেন বলে জানালেন। অন্য কেউ হলে বলতেন– আজ থাক, অন্যদিন সুস্থ হয়ে শুটিং করব। তিনি বুঝেছেন নির্মাতা যে কাজ আজকে করতে চেয়েছেন, তা শেষ করতেই হবে। এ কাজের সঙ্গে অন্যদের শিডিউল মেলানো আছে। প্রযোজক আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। এই যে চারদিকে তাঁর দৃষ্টি ছিল– এটি সবাইকে মুগ্ধ করত।
আমার দ্বিতীয় সিনেমা ‘চিৎকার’-এ তিনি বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন। ওই সিনেমার গল্প একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ঘিরে আবর্তিত। প্রাসঙ্গিক ভাবনাগুলো তাঁকে বেশ আলোড়িত করত। এই গল্পটি তাঁর জীবনের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল বলে খুব উৎসাহ নিয়ে অভিনয় করেছেন। নানা বিদ্বেষ ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার নিজস্ব ভাষা রপ্ত ছিল চিত্রনায়ক ফারুকের। সংলাপে যা না পারতেন, বাহ্যিক ক্রিয়াতে বুঝিয়ে দিতেন। এ বিষয়গুলো নির্মাতারা তাঁর কাছ থেকে আবিষ্কার করতে পেরেছেন। গুণী নির্মাতা আমজাদ হোসেন ফারুক ভাইকে নতুন এক জীবন ও জগৎ তৈরি করে দিয়েছিলেন। নতুন নতুন দৃশ্যপটে তাঁকে হাজির করেছেন। আমজাদ হোসেনের সিনেমায় তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলো দর্শক বেশ গ্রহণ করেছেন। ফারুক ভাইয়ের অভিনয়জীবনকে গড়ে  দেওয়ার পেছনে এ টি এম শামসুজ্জামান, নারায়ণ ঘোষ মিতা, ফজলুর রহমানের ভূমিকা অনেক। সহকর্মীরাও তাঁকে সাপোর্ট দিয়েছেন। ফারুক ভাই তৈরি হয়েছেন প্রতিবাদের মুহূর্ত চেনা ও প্রতিবাদের মুহূর্ত বোঝার ভেতর দিয়ে। তাঁর রাজনৈতিক জীবনাদর্শ থেকেও অভিনয়ের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। যেখানে তিনি এই ধরনের চরিত্র দেখেছেন, সেখানেই তিনি তাঁর ফ্ল্যাশব্যাকে, অর্থাৎ পেছনে চলে গেছেন। তিনি তো প্রতিবাদ করতেই শিখেছেন। ছাত্রজীবনেও প্রতিবাদ করেছেন। ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। গল্পের পটভূমি ও চরিত্রায়ণ– সবকিছু মিলিয়ে ফারুককে সবার থেকে আলাদা করেছেন দর্শক এবং সিনেমার পর্দাভাষা।
এবার ব্যক্তি ফারুক ভাইয়ের কথায় আসা যাক। তাঁকে দেখলে মনে হবে তিনি ভীষণ রাগী, মেজাজি, অহংকারী একজন মানুষ। আসলে তা নয়। মনে পড়ে তাঁকে নিয়ে ‘শান্তাহার আমার দেশ’ সিনেমার শুটিং করেছিলাম ২৫ দিন। শীতের মধ্যে সারারাত শুটিং করেছি। একটু বিরক্ত হননি তিনি। এই তাঁর শিল্পমন– কাজ করতে হবে। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আমরা যখন আন্দোলন করেছি, তখন শিল্পী ফারুক সাংগঠনিক, সংগ্রামী কর্মী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এফডিসির নানা জটিলতা, প্রতিবন্ধকতা তিনি দূর করেছেন। সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে ভাবতেন। আড্ডাবাজ, খুব প্রাণবন্ত ছিলেন। সারাদিন উৎসবে মেতে থাকতেন। সেই দিনগুলোর কথা এখন খুব মনে পড়ছে।

দেলোয়ার জাহান ঝন্টু

ফারুক ভাই ছিলেন চলচ্চিত্রের ‘মিয়া ভাই’। তবে আমাদেরও তিনি একই নামে ডাকতেন। এফডিসিতে এলেই ‘মিয়া ভাই আসেন’, ‘মিয়া ভাই চা খান’ বলে কাছে টেনে নিতেন। শব্দগুলো এখনও কানে বাজে। জীবনে অনেক মানুষ দেখেছি, কিন্তু তাঁর মতো সুন্দর মনের মানুষ দেখিনি। সব সময়ই অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতেন। চলচ্চিত্রের মানুষের বিপদে-আপদে এগিয়ে আসতেন। অতুলনীয় একজন অভিনেতা তিনি। বিশেষ করে গ্রামীণ সিনেমায় তিনি ছিলেন অনবদ্য। সংসদ সদস্য হওয়ার পর রসিকতা করে তাঁকে একদিন এমপি সাহেব বলে ডেকেছি। বললাম, ‘শিডিউল-টিডিউল দিয়েন। ভুলে যাইয়েন না চলচ্চিত্রকে।’ উত্তরে বললেন, দরকার হলে এমপিগিরি ছেড়ে দেব। অভিনয়জগৎ দিয়ে আমার পরিচিতি। চলচ্চিত্রকে কীভাবে আমি ভুলব।

সোহানুর রহমান সোহান

শিবলী সাদিকের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করি। তাঁর ‘রেশমী চুড়ি’ সিনেমায় কাজ করেন ফারুক ভাই। ওই সিনেমায় কাজের সুবাদে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। এরপর ‘তিন কন্যা’য় একসঙ্গে কাজ হয়। ওই সময় আমার জন্ডিস ধরা পড়ে। বাছবিচার করে খাওয়াদাওয়া করতে হতো। বিষয়টি তিনি [চিত্রনায়ক ফারুক] খেয়াল করলেন। আমার জন্য আলাদা করে খাবার বাসা থেকে নিয়ে আসতেন। কোনো তারকা শিল্পী সহকারী নির্মাতার জন্য বাসা থেকে খাবার নিয়ে এসেছেন– এমন কথা কারও কাছে শুনিনি। ফারুক ভাই কান্নার দৃশ্যে গ্লিসারিন ব্যবহার করতেন না। একদিন তাঁকে বললাম, আপনি কোনো কষ্ট না পেয়ে চোখে পানি কীভাবে আনেন? উত্তরে বললেন, যখন কোনো কষ্টের দৃশ্যে অভিনয় করি, তখনই সবাইকে চুপ করিয়ে দিই। জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট মনের মধ্যে নিয়ে আসি। আবেগতাড়িত হই। তখন কান্না চলে আসে। সংসদ সদস্য হওয়ার পরে তাঁর ব্যস্ততা বেড়েছিল। কিন্তু চলচ্চিত্রের মানুষকে তিনি কখনও দূরে সরিয়ে রাখেননি। তিনি মানুষের জন্য ভাববেন, করতেন।