
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে মহাকাশে নভোচারীদের আবাসস্থল হিসেবে কাজ করছে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন (আইএসএস)। ১৯৯৮ সালে রাশিয়ার জারিয়া মডিউল স্থাপনের মধ্য দিয়ে আইএসএসের যাত্রা শুরু হয়। মহাকাশে মানব-নির্মিত বৃহত্তম এ কাঠামো নির্মাণের জন্য কয়েক ডজন দেশ একসঙ্গে কাজ করে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দুই শত্রুকে এক সুতোই বেঁধেছিল এ প্রকল্পটি। অংশীদারিত্বের সূচনা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে।
অবশেষে আইএসএসের বিদায় নেওয়ার সময় হয়েছে। আগামী ৮ বছরের মধ্যে মৃত্যু হবে বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা ও মানুষের সক্ষমতার এ প্রতীকের। স্টেশনটিকে কক্ষপথ থেকে ছাড়িয়ে পৃথিবীতে নামিয়ে সমুদ্রে সমাহিত করার পরিকল্পনা করছে নাসা। তবে শেষ বিদায়ও হবে চমকপ্রদ। সূত্র : বিবিসি
যাই হোক, আইএসএস ধ্বংসের মধ্য দিয়ে মানব সহযোগিতার একটি নজিরবিহীন অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটবে। ইউক্রেনে রাশিয়ার সাম্প্রতিক আগ্রাসনের পর প্রকল্পটিকে কঠোরতম পরীক্ষা দিতে হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত প্রকল্পটি চলমান রয়েছে। তবে অদূরভবিষ্যতে এই ধরনের অংশীদারিত্ব অসম্ভব বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ইউএস এয়ারফোর্সের স্কুল অব অ্যাডভান্সড এয়ার অ্যান্ড স্পেস স্টাডিজের স্পেস পলিসি বিশেষজ্ঞ ওয়েন্ডি হুইটম্যান কোব বলেন, এটি সত্যিই স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সহযোগিতার একটি দুর্দান্ত গল্প। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে একসঙ্গে কাজ করার নতুন যুগের সূচনা করেছিল।
একটি ফুটবল মাঠের সমান বড় এবং ৪০০ টন বা ২০০টি হাতির মোট ওজনের চেয়েও ভারী এই বিশালাকার আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন তৈরিতে ব্যয় হয়েছিল অন্তত ১৫ হাজার কোটি ডলার। সেখানে প্রথম নভোচারী যান ২০০০ সালে। তারপর থেকে ২০টি দেশের আড়াই শতাধিক নভোচারী সেখানে থেকেছেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্টেশনটির আয়ুষ্কাল শেষের পথে। ২০৩১ সালে এটিকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ফিরিয়ে আনা হবে।
আইএসএসে হাজার হাজার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। গবেষণাগুলোর মধ্যে আলঝেইমার ও পারকিনসন রোগ থেকে শুরু করে পদার্থের নতুন অবস্থার অধ্যয়ন এবং লেটুস ও মুলার মতো মহাকাশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর উপায়গুলো অন্তর্ভুক্ত। ২০০২ ও ২০০৯ সালে দু’বার স্টেশন পরিদর্শন করা ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির একজন নভোচারী ফ্রাঙ্ক ডি উইন বলেন, স্টেশনে থাকা ও কাজ করা একটি দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা ছিল। এটি আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব ও মানবতাকে এগিয়ে নেওয়ার গল্প।
আশা করা হচ্ছে, নতুন বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশনগুলো আইএসএসের জায়গা নেবে। নাসা ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেসএক্স ও বোয়িং কোম্পানির মাধ্যমে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে মানুষ পরিবহন করেছে। তবে স্পেস স্টেশনটিকে ধ্বংস করাও সহজ কোনো কাজ নয়। হার্ভার্ড-স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের মহাকাশবিজ্ঞানী জোনাথন ম্যাকডাওয়েল বলেন, এটা এক বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ ৪০০ টন ওজনের একটা জিনিস আকাশ থেকে খসে পড়ছে– এটা কোনো সহজ ব্যাপার নয়। আইএসএসের পৃথিবীতে ফেরার দৃশ্য হবে অনেক চমকপ্রদ।
আশা করা হচ্ছে সবকিছুই পরিকল্পনা মতো কাজ করবে এবং আইএসএসের জ্বলন্ত টুকরোগুলো মানুষের জন্য বিপদ সৃষ্টি করবে না। আইএসএসের এক বিরাট অংশই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলেই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। যতটুকু অবশিষ্ট থাকবে সেগুলো পড়বে ‘পয়েন্ট নেমো’ নামে প্রশান্ত মহাসাগরের একটি বিস্তীর্ণ এলাকায়। নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আমেরিকার মাঝখানে থাকা এ জায়গাটিকে বেশিরভাগ মহাকাশযানের কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
মন্তব্য করুন