সমকাল: ফ্লোর প্রাইস নিয়ে বিএসইসির এখনকার পরিকল্পনা কী?

শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ: এ বিষয়ে এই মুহূর্তে সুনির্দিষ্ট কোনো চিন্তাভাবনা কমিশনের নেই। আমাদের ভাবনায় শুধু সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সুরক্ষা ও স্বার্থ রক্ষা। এর প্রভাব বা ফলাফল কী, তা সময় সময় পর্যালোচনা করছি।

সমকাল: ৩৯২ শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ২১৪টি বা বাজার মূলধনের ৭৬ শতাংশ এবং ফ্রি-ফ্লোট শেয়ারের ৭২ শতাংশ এখনও ফ্লোর প্রাইসে। ক্রেতা না থাকায় গত ১০ মাস ধরে চাইলেও এসব শেয়ার কেউ বিক্রি করতে পারছেন না। তাহলে কী করে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা হচ্ছে?

শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ: গত কিছু দিনে অনেক শেয়ার ফ্লোর প্রাইস ছেড়েছে। অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। যদি এই ৯০ শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস না থাকত, তাহলে দরপতনে অনেকের ক্ষতি হতো। আমরা চেষ্টা করছি, অবস্থার যাতে দ্রুত উন্নতি হয়। আমরা এও লক্ষ্য করছি, বাজারে নতুন বিনিয়োগ আসছে। বেশ ক’দিন ধরে প্রতিদিনই ৫০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে। কিছুদিন এভাবে লেনদেন চললে আরও শেয়ার ফ্লোর প্রাইস ছাড়বে।

সমকাল: কীসের ভিত্তিতে এ আশা করছেন?

শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ: আগের তুলনায় ব্যাংক খাত অনেক বেশি সহায়ক ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি-সহায়তাও এ ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। তারা বন্ডে বেসরকারি ব্যাংকের বিনিয়োগকে শেয়ারবাজার এক্সপোজার থেকে বাদ দিতে আইন সংশোধনের প্রস্তাব করেছে। একই সঙ্গে বাজারকে গতিশীল রাখতেও কাজ করতে বলেছে ব্যাংকগুলোকে। এগুলো কার্যকর হলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের সুযোগ বাড়বে। ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। মানি মার্কেট যদি ক্যাপিটাল মার্কেটকে সহায়তা দেয়, তাহলে শেয়ারবাজারে খারাপ দশা থাকবে না। তবে এটাও ঠিক, রাতারাতি সব ঠিক হয়ে যাবে না। একটু সময় লাগবে। এখানে একটা কথা বলতে চাই, ফ্লোর প্রাইস বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে মানানসই নয়। তারপরও এখন আমরা এটা রাখতে চাই, যাতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগের যৎসামান্য যে বিনিয়োগ আছে, তা যেন হারিয়ে না যায়।

সমকাল: আপনি লেনদেন বৃদ্ধির কথা বলছিলেন। এও বলেছেন, অনেক শেয়ার ফ্লোর প্রাইস ছেড়েছে। কিন্তু এখনও লেনদেনের বেশিরভাগ জুড়ে থাকছে ২০-৩০টি শেয়ার। বন্ধ বা রুগ্‌ণ কোম্পানির শেয়ারের বড় অঙ্কের লেনদেন হচ্ছে...

শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ: দেখুন, কে কোন শেয়ার কিনবেন, তা আমরা ঠিক করে দিতে পারি না। আমরা চেয়েছি, বাজারে বিনিয়োগ তহবিল আসুক। আশার কথা, তা এরই মধ্যে আসতে শুরু করেছে। ফলে যেসব শেয়ার ফ্লোরে আটকে ছিল, তার কিছু বেরিয়ে আসছে। এখনও যে বড় ও ভালো শেয়ারগুলো আটকে আছে, চলতি ধারা অব্যাহত থাকলে, সেগুলোও এক সময় ফ্লোর ছাড়বে।

সমকাল: কমিশন চেয়ারম্যান সম্প্রতি একাধিক গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিএসইসি ফ্লোর প্রাইস তুলবে না, বেশি দরে শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারীদেরই তুলতে হবে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ: চেয়ারম্যান মহোদয় এমন কথা বলেছেন কিনা, তা আমার জানা নেই। তবে আমি মনে করি না, ফ্লোর প্রাইস তোলার দায়িত্ব শুধু বিনিয়োগকারীদের। এ দায়িত্ব সবার। তবে কমিশন যেহেতু ফ্লোর প্রাইস দিয়েছে, তাই তোলার ক্ষেত্রে কমিশনের দায়ই বেশি। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদেরও কিছু করার আছে। ফ্লোর প্রাইস আরোপ হয়েছিল, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের দরপতনের দুশ্চিন্তা দূর রক্ষা করার চিন্তা থেকে। লক্ষ্য করবেন, দরপতনের দুশ্চিন্তা এখন নেই। কিন্তু ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া হলে কিছু বিনিয়োগকারীর যে ক্ষতি হবে, তাতে কেউ ‘অঘটন’ করে বসলে, তার দায় কে নিয়ন্ত্রণ করবে। তাই আমরা সুন্দরভাবে সবকিছু সমাধানের চেষ্টা করছি।

সমকাল: গত মার্চ প্রান্তিক শেষে বেশিরভাগ কোম্পানির মুনাফা বেড়েছে বা কমেছে, কিন্তু শেয়ারদর আগের জায়গায়। আপনার কী মত?

শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ: কোম্পানিগুলোর ব্যবসা কমার কারণ যতটা না অভ্যন্তরীণ, তার থেকে বেশি বৈশ্বিক। বিশেষত জ্বালানির দামের প্রভাব সবকিছুতে পড়েছে। রপ্তানি হয়তো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছে না। যেহেতু ব্যবসা কমার দায় কোম্পানির নয়, তাই শেয়ারদর কমলে বিনিয়োগকারীদের যে ক্ষতি, তা থেকে তাঁদের বাঁচাতে আমাদের বিকল্প চিন্তা করতে হয়েছে।

সমকাল: যুদ্ধ বা বৈশ্বিক সংকটের নেতিবাচক প্রভাবে তো কেবল বাংলাদেশই ক্ষতিগ্রস্ত নয়। শুধু বাংলাদেশের শেয়ারবাজারেই কেন এই বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা?

শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ: এর কারণ দেশের অর্থনীতি যতটা ভালো ও বড়, শেয়ারবাজার ততটা নয়। এখানে ২ লাখ কোম্পানি নিবন্ধিত। কিন্তু শেয়ারবাজারে ৪০০টিও তালিকাভুক্ত নয়। আমরা দেশের নামকরা যত কোম্পানির নাম জানি, তার ক’টি এ বাজারে আছে? বাজারটি যদি বড় না হয়, এর গভীরতা যদি কম থাকে, তাহলে একটুতেই বেশি অস্থির হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের মৌলিক ব্যর্থতা, আমরা বাজারটিকে প্রকৃত পুঁজিবাজার হিসেবে গড়তে পারেনি। এ কারণে ফ্লোর প্রাইসের মতো বিকল্প চিন্তা করতে হয়েছে।

সমকাল: গত এক সপ্তাহের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ফ্লোর প্রাইসে পড়ে থাকা কোম্পানিগুলোর মাত্র ৯০০ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রির আদেশ থাকছে। যার কারণে বিনিয়োগকারীদের ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে আছে। আমাদের বাজার কী এতটা ছোট, এই টাকার শেয়ার কেনার কেউ নেই?

শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ: ৯০০ কোটি বা হাজার কোটি টাকা তো এ বাজারের জন্য অনেক বেশি টাকা নয়। আমার মনে হয়, এ শেয়ারগুলো কেনা গেলে পুরো বাজার ঘুরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আগে কমিশন বা স্টক এক্সচেঞ্জের গবেষণা বিভাগ থেকে এমন তথ্য পেলে কাজ করতে সুবিধা হতো। এ বিষয়ে আমি কাজ করব। আপনার এ তথ্য সত্য হলে, বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সবার সঙ্গে কথা বলব।