হবিগঞ্জ শহর থেকে বানিয়াচং উপজেলা সদরের দিকে যেতে চোখে পড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি নামফলক। তাতে লেখা শুটকি নদী। সেখানেই নদীর ওপর পাশাপাশি দুটি লোহার সেতু। একটি অচল, অন্যটি সচল। ১১ মে দুপুর ১টা। সেতুর ডান দিকে নদী দিয়ে বড় একটি মহাজনি নৌকা আসতে দেখা যায়। কাছাকাছি এলে জানা যায়, প্রায় দেড়শ ফুট লম্বা নৌকাটি হবিগঞ্জ থেকে সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীতীরের চৌহালী উপজেলায় ফিরছে। ৪২ জন কৃষিমজুর বানিয়াচংয়ে ধান কেটে মজুরি হিসেবে পাওয়া সাড়ে এগারশ মণ ধান নিয়ে নদীপথেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। এভাবে ভাটিতে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদী হয়ে তাঁরা সিরাজগঞ্জে পৌঁছাবেন। নৌকার কর্ণধার সুন্নত মাঝি জানালেন, শুকনা মৌসুমেও শুটকি নদীর পুরোটাই তাঁরা নাব্য পেয়েছেন। অর্থাৎ শুটকি একটি প্রবাহিত নদী। বর্ষায় হাওরের পানির নিষ্কাশন হয় এই নদী দিয়ে।

তবে শুটকি নদীটি নাব্য হলেও জায়গায় জায়গায় সিমেন্টের ব্লক ফেলে রাখা। এ কারণে সুন্নত মাঝির নৌকার কয়েকজন শ্রমিক পানিতে নেমে দেখছেন কোথায় কোথায় বাঁধ বা ব্লক আছে। স্থানীয় কৃষক আরাফাত মিয়া তাঁর জমি থেকে নদীর পাড় দিয়ে ফিরছিলেন। তিনি জানালেন, নদীর ‘মালিক’ রাজা সাহেব এর বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ দিয়ে রাখেন। “আমরা এই নদীতে চলাচল ও মাছ ধরতেও পারছি না; আমার বাপেও পারছে না।” কারণ নদীটি ব্যক্তিমালিকানায় রয়েছে। মালিক বানিয়াচংয়ের প্রভাবশালী সাবেক জমিদার পরিবার। এই পরিবারের বর্তমান প্রতিনিধি দেওয়ান আহমদ রাজার প্রতিষ্ঠান ইয়াহিয়া ফিশারিজ (প্রাইভেট) লিমিটেড নদীটির মালিক। ‘নদীতে নামলেই রাজা সাহেবের লোক বন্দুক নিয়া আসে’– অভিযোগ আরাফাত মিয়ার।

প্রায় ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটি অস্তিত্বশীল হলেও আদালতের কাছে একে ‘বদ্ধ জলাভূমি’ হিসেবে দেখিয়ে পারিবারিক সম্পত্তি করে ফেলা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হবিগঞ্জ শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ বলেন, ‘শুটকি অবশ্যই প্রবাহিত নদী, কোনো বদ্ধ জলাভূমি নয়।’ পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১৮ সালে হাওরের জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১ কোটি টাকা ব্যয়ে শুটকি নদীর ৪ কিলোমিটার এলাকা খনন করে। ব্যক্তিগত নদীতে কেন পানি উন্নয়ন বোর্ড খনন করল– এ প্রশ্নের জবাবে ইয়াহিয়া ফিশারিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমদ রাজা বলেন, ‘তারা আমার কাছ থেকে আবেদনের মাধ্যমে লিখিত অনুমতি নিয়ে খনন করেছে।’

নদীর মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আহমদ রাজা বলেন, “ইয়াহিয়া ফিশারিজ ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি। আমরা নিয়মিত আয়কর রিটার্ন জমা দিই। শুটকি কোনো নদী না, ‌‘এটা খাল বা জলাধার।’ ফিশারিজের কোনো স্থাপনা বা যন্ত্রপাতি কিছু নেই কেন– বলা হলে আহমদ রাজা উত্তর দেন, ‘সব ছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় পুড়ে গেছে। এটা আমাদের পারিবারিক তালুকের সম্পত্তি। জমিদারি আমলে বোরো ধান চাষের জন্য পানি ধরে রাখতে আমার পূর্বপুরুষ এই খালটা খনন করে। আমরা পাকিস্তান আমলেও খাজনা দিয়েছি। জমির নামজারিও আমাদের পক্ষে ছিল। নদীর মালিকানার পক্ষে আমরা আদালতের তিনটি রায় পেয়েছি।”

স্বাধীন দেশের প্রথম নদী দখলের মামলা

সুলতানি আমল ও তার পরের মোগল আমলে নদী ও ভূমির মালিকানা সর্বশক্তিমান আল্লাহর বলে বিবেচিত হতো। ব্যক্তি কেবল ভোগদখল করতেন এবং দেওয়ান ও তাঁর কর্মচারীরা কেবল খাজনা আদায় করতেন। ইংরেজ শাসনের সময় ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের বলে প্রথমবারের মতো জমিদার ও তালুকদাররা নদী ও ভূমির মালিকানা পান। পরে পাকিস্তান আমলে ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বাতিল করতে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ জারি করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে সরকার দেশের একমাত্র জমিদারে পরিণত হয়। খনি এবং নদী ও জলাশয়ের মালিকানা সরকারে বর্তায়। জমিদাররা ক্ষতিপূরণও পান। কিন্তু জমিদারি চলে যাওয়ার পর বানিয়াচংয়ের সাবেক জমিদার আলী আহমদ রাজার ভাই ইয়াহিয়া রাজা ১৯৬০ সালে ইয়াহিয়া ফিশ ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান বানান। পাকিস্তান আমলে হারানো জমিদারি ভোগের হাতিয়ার হয় এই ভুঁইফোঁড় কোম্পানিটি। কিন্তু পাকিস্তান আমলে নদীর দখল না পেলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তাঁরা সেই সুযোগ পান। ১৯৭২ সালে সিলেট সাব-জজ আদালতে ইয়াহিয়া ফিশ ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেডের পক্ষে দেওয়ান ইয়াহিয়া রাজা নদীর মালিকানা দাবি করে একটি স্বত্ব মামলা করেন। শুটকি নদীকে বিল দেখিয়ে তিনি নদীর ভূমি তাঁর ইন্ডাস্ট্রির নামে ঘোষণা, দখল এবং ভোগের দাবি করেন। ১৯৭৩ সালে সিলেট সাব-জজ আদালত তাঁর পক্ষে আদেশ দেন। ওই মামলার আইনজীবী বলেছিলেন, মামলাটিতে খালবিল বা নদী, নালা কিনা তা বিবেচনায় আনা হয়নি। এর পর ১৯৭৪ সালে ২৪ এপ্রিল বাদীপক্ষ আদালত থেকে নামজারির আদেশও পান। এভাবে বিভিন্ন সময়ে সরকার পক্ষের গাফিলতি ও অনুপস্থিতির সুযোগে আদালতের রায়ের মাধ্যমে ইয়াহিয়া রাজা শুটকি নদীর মালিক বনে যান।


উদ্ধারের চেষ্টা ও ছয় কর্মকর্তার সিভিল জেল

১৯৯২ সালে এসে বাদ সাধেন সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিষ্ণুপদ সাহা। ১৯৯২ সালের ১০ মার্চ তিনি ইয়াহিয়া ফিশ ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক দেওয়ান ইয়াহিয়া রাজাকে কারণ দর্শানের নোটিশ দেন। নোটিশে বলা হয়, ইয়াহিয়া রাজার দাবি করা ভূমি শুটকি নদীর অংশ। ফলে কোম্পানির নামে নামজারি কেন বেআইনি হবে না? শোকজের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় সরকার পক্ষ রিভিউ মামলা করে ইয়াহিয়া রাজার নামজারি আদেশ বাতিল করে সরকারের নামে রেকর্ড পুনর্বহাল করাতে সক্ষম হয়। ওই আদেশের বিরুদ্ধে ১৯৯৬ সালে ইয়াহিয়া রাজা হবিগঞ্জ যুগ্ম জেলা জজ আদালতে আবারও ১৯৭২ সালের মতো স্বত্ব জারি মামলা করেন। দীর্ঘদিন পর ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মামলার রায় হয়। ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, আদেশের তিন মাসের মধ্যে বিবাদীরা মামলার বাদীর নামে নামজারি করে দিতে হবে। অন্যথায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান ছয় কর্মকর্তাকে তিন মাসের দেওয়ানি কয়েদে (সিভিল জেল) আটক রাখার নির্দেশও দেওয়া হয়। হবিগঞ্জের যুগ্ম জেলা জজ মিথিলা ইসলাম ওই আদেশটি দেন। কর্মকর্তাদের ‘অপরাধ’ তাঁরা আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে শুটকি নদী থেকে ইয়াহিয়া ফিশারিজের নামজারি বাতিল করেছিলেন। শাস্তির ওই রায়ের বিরুদ্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে রিভিশন মোকদ্দমা এখনও চলমান। আবার সরকারিভাবে ইজারা দেওয়ার বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া ফিশারিজের পক্ষ থেকে একটি রিট পিটিশন উচ্চ আদালতে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

৫০ বছরের নদী লুটের বখরা

আদালতের রায়ে নদীর মালিক বনে যাওয়া ইয়াহিয়া ফিশ ইন্ডাস্ট্রিজ শুটকি নদীর বানিয়াচং অংশের ২৪২.২০ একর এলাকা ইজারা দিয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করছে। এই নদীর মাছ যেমন সুস্বাদু, তেমনি নদীর বালুও মূল্যবান। ইজারা ও বালু তোলার মাধ্যমে ইয়াহিয়া ফিশ ইন্ডাস্ট্রিজ বিপুলভাবে লাভবান হলেও ইজারা দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন আহমদ রাজা। অথচ বানিয়াচং দক্ষিণ-পূর্ব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরফান উদ্দিন ১১ মে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার বাবাও ইজারা নিয়েছিলেন। আমরা তখন মাছ ধরেছি। এই নদী সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। কেউ মাছ ধরতে নামতে পারত না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পক্ষ যেমন নাসির, ফয়সাল, আমান এরাও ইজারা নিয়েছে। ৩০-৪০ লাখ টাকায় ইজারা হতো। কোটি টাকার মাছ বিক্রি হতো। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে বড় আয়োজন করে মাছ ধরা হয়। এ ছাড়া সারা বছর যখন চায় তখনই তো ধরতে পারে। এতদিন আহমদ রাজাই ইজারা দিতেন।’

মালিকানা ব্যক্তির নামে, ইজারা দিচ্ছে প্রশাসন

কিন্তু সমস্যা হয় হবিগঞ্জের নতুন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান আসার পর। ২০২১ সালের মার্চ মাসে যোগদান করার পর তিনি নতুন কৌশল নেন। তাঁর তদারকিতে ২০২২ সালের ২৬ জুলাই বাংলাদেশ সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয় শুটকি নদীকে ‘বদ্ধ’ বলে দাবি করে জেলা প্রশাসনকে নদীটি ইজারা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে বানিয়াচংয়ের ইউএনও জয়দুর্গা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড বরাবর বাংলা ১৪২৮-১৪৩৩ সাল, অর্থাৎ ছয় বছরের জন্য বার্ষিক ৬ লাখ ৫ হাজার টাকায় নদীর এলাকা ইজারা দেন। ইজারার মূল্য নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সমস্যা অন্য জায়গায়। শুটকি নদীর নালিশিকৃত ভূমির মালিকানার বিষয়টি এখনও বিচারাধীন থাকা অবস্থায় সরকার ইজারা দিতে পারে কিনা। যদিও ভূমি মন্ত্রণালয়ের ৩১,০০,০০০০,০৫০.৬৮.০১১.২২-৪৬৪ নং স্মারকে ইজারার নির্দেশে বলা হয়েছে, ‘কোন মামলায় স্থগিতাদেশ/নিষেধাজ্ঞা থাকলে তা প্রত্যাহার সাপেক্ষে’ শুটকি নদী (বদ্ধ) ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত। খেয়াল করার বিষয়, আদালতের মাধ্যমে মালিকানা ভোগকারী ইয়াহিয়া ফিশারিজ এবং বাংলাদেশ সরকার উভয়ই নদীটিকে ‘বদ্ধ’ বলে দাবি করেছে। এ বিষয়ে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসককে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “এটা তো অনেক বছর আগে থেকেই ইজারা দেওয়া হতো। এখন সরকারি দখলে রাখার জন্য আমরা ‘বদ্ধ জলাশয়’ হিসেবে ইজারা দিয়েছি। না হলে এটাকে রক্ষা করা যেত না। তবে আদালতের সর্বশেষ রায় হাতে পেলে তখন হয়তো শুটকি নদীকে ইজারা রেজিস্টার থেকে বাতিল করা যাবে।”

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইটের নদনদীর তালিকায় শুটকি নদীর নাম রয়েছে। অথচ সেই সাইটেই রাখা দখলকৃত নদী ও দখলদারের তালিকায় শুটকি নদীর নাম নেই, ইয়াহিয়া ফিশ ইন্ডাস্ট্রিজ বা আহমদ রাজার নাম নেই। ২০১৮ সালে বানিয়াচং উপজেলা ভূমি অফিসের সরেজমিন তদন্তে দেখা যায়, বানিয়াচংয়ের ৩২টি মৌজার বিভিন্ন দাগে ৪৬১ একর ভূমির ওপর নদীটি প্রবাহিত। অফিসের খাতাপত্রেও এসএ ও আরএস খতিয়ানে এটি নদী বলে উল্লিখিত। সেই একই প্রশাসন গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে মাছ ধরার মৌসুমে লাল পতাকা পুঁতে পুলিশসহ গিয়ে নদীর দখল ইজারাদারকে বুঝিয়ে দেন।

একদিকে শুটকি নদীকে কোম্পানির নামে নামজারি করার জন্য আদালতের নির্দেশ, অন্যদিকে জেলা প্রশাসনের ইজারাদান দেখে সেই গানটার কথাই মনে হয়, ‘ও নদীরে, তোর বুঝি কোন ব্যথার দোসর নাই।’