- সারাদেশ
- তল্লাশি অভিযান গ্রেপ্তার, খবর জানে না পুলিশ
গাজীপুর সিটি নির্বাচন
তল্লাশি অভিযান গ্রেপ্তার, খবর জানে না পুলিশ

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুনের গণসংযোগ। মঙ্গলবার তোলা -সমকাল
টেবিল ঘড়ি প্রতীকের স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের সমর্থক এবং বিরোধী দলের কয়েকজন নেতাকর্মী শনিবার রাত থেকে নিখোঁজ। অনেক তালাশের পর গতকাল সোমবার তাঁদের খোঁজ মেলে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে। তাঁরা হলেন– টঙ্গী পূর্ব থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য রাসেল মিয়া, টঙ্গী ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মোস্তফা হায়দার কামাল ও ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের গাজীপুরার বাসিন্দা রেজাউল করিম। তিনজনের পরিবার দাবি করেছে, শনিবার রাতে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাঁদের বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়। পরে জানা যায়, পুরোনো এক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
এদিকে টঙ্গীর ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য সচিব কামাল হোসেনের খোঁজ মেলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। পুলিশভ্যানে হাতকড়া অবস্থায় তাঁর ছবি এরই মধ্যে ফেসবুকে ছড়িয়েছে। তিনি সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের অনুসারী। গাজীপুর সিটির ভোট যত ঘনিয়ে আসছে, পুলিশের তৎপরতাও সমানতালে বেড়েছে। জায়েদা খাতুন ও সরকারবিরোধী নেতাকর্মীর বাসায় রাতের আঁধারে ঘন ঘন পুলিশের তল্লাশির খবর মিলছে। তবে পুলিশ দাবি করেছে, তল্লাশি, অভিযান কিংবা গ্রেপ্তারের খবর তাদের কাছে নেই। ভোট ঘিরে বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলেও এ পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে সাধারণ মানুষের শঙ্কা পুরোপুরি কাটছে না। যদিও গতকাল সোমবার ঢাকায় নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর দাবি করেছেন, গাজীপুর সিটির ভোটের পরিবেশ অত্যন্ত ভালো। শান্তিপূর্ণভাবে প্রার্থীরা প্রচার চালাচ্ছেন। ভোটের দিন এবং ফল ঘোষণার সময় পর্যন্ত এ পরিবেশ বজায় থাকবে। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শেষ হচ্ছে আজ মঙ্গলবার। আগামী বৃহস্পতিবার ৪৮০ কেন্দ্রের সবকটিতেই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) মেয়র ও কাউন্সিলর পদে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট নেওয়া হবে। নির্বাচনে মেয়র পদে ৮ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৩৯ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৭৭ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রচারের শেষ সময়ে এসে প্রার্থীরা ভোটারদের আকৃষ্ট করতে নানা কৌশলে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় জানিয়েছে, আনুষ্ঠানিক প্রচার শেষ হওয়ার সঙ্গে বহিরাগতদেরও এলাকা ছাড়তে হবে। ভোটের দিন নির্বাচনী এলাকায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ভোটের ১২ ঘণ্টা আগে মোটরসাইকেলসহ যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধ করা হবে। তবে মহাসড়কে আন্তঃজেলা পরিবহনের যান চলাচল থাকবে এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে।
দেশের সবচেয়ে বড় এই সিটি করপোরেশনের প্রায় ১২ লাখ ভোটারের একটি বড় অংশই শিল্পকারখানার শ্রমিক। তাঁদের জন্য ইভিএমে ভোট দেওয়া কতটা স্বস্তিকর হবে, তা নিয়ে অনেকের শঙ্কা রয়েছে। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খানও এ বিষয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে জানিয়েছেন। তবে ইভিএম নিয়ে অন্য রকম শঙ্কা রয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের প্রধান এজেন্ট জাহাঙ্গীর আলম ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমানের। তাঁরা মনে করছেন, ইভিএমে ফল পাল্টে দিয়ে নৌকা প্রার্থীকে জয়ী করা হতে পারে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) গাজীপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির বলছেন, ২০১৮ সালের অভিজ্ঞতার আলোকে এবারের ভোট নিয়ে শুরুতে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে অনীহা ছিল। তবে প্রচার শেষে এখন দেখা যাচ্ছে, কাউন্সিলর প্রার্থীদের কারণেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোট দিতে যাওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে না থাকলেও এবার কেন্দ্রে ভোটারদের ভালো উপস্থিতি থাকবে বলে তিনি ধারণা করছেন। তিনি জানান, কয়েক দিনে পুলিশের তৎপরতা বেড়েছে। রাতের আঁধারে পুলিশের তল্লাশির খবর পাওয়া যাচ্ছে। ফলে ভোট নিয়ে আতঙ্ক কাটছে না।
নগর বিএনপির সাবেক নেতা ডা. মাজহারুল আলম বলেন, এই নির্বাচনে বিএনপি শুধু প্রার্থী দেওয়া থেকেই বিরত থাকছে না। বিএনপিপন্থি ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করছে। কেন্দ্রীয়ভাবে আমরা এমন নির্দেশনা পেয়েছি। তিনি বলেন, গাজীপুরে সাধারণ ভোটাররাও মনে করছেন, এই ভোট সুষ্ঠু হবে না। নির্বাচন যেমনই হোক, যে কোনো উপায়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে জয়ী করা হবে।
গাজীপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ওয়াজউদ্দিন মিয়া বলেন, ভোট নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে মানুষ ভোট দেবে এবং নৌকার প্রার্থী বিপুল ভোটে জয়ী হবে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে শুরু থেকেই এই নির্বাচনকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বলা হয়েছে। যদিও সুশাসনের জন্য নাগরিক প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ নিয়ে গতকাল গাজীপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, এ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাড়ি বাড়ি পুলিশি তল্লাশি ও গ্রেপ্তার এদিকে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের সমর্থক ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীর বাড়িতে গভীর রাতে পুলিশের তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের খবর মিলেছে। গত শনিবার রাতে তুলে নেওয়া বিএনপি নেতা রাসেল মিয়া, মোস্তফা হায়দার কামাল ও রেজাউল করিমকে রূপগঞ্জ থানার বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাদের নারায়ণগঞ্জ কারাগারে পাঠানো হয়। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব গোলাম ফারুক খোকনকে প্রধান আসামি করে বিএনপির ৩৯ নেতাকর্মীর নামে গত ২৮ নভেম্বর রূপগঞ্জ থানায় মামলাটি করা হয়েছিল। রাসেল মিয়ার স্ত্রী তানিয়া জানিয়েছেন, দু’দিন নিখোঁজ থাকার পর তাঁরা রাসেলের খোঁজ পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জ কারাগারে। এদিকে কোনাবাড়ী ৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব ও সাবেক মৎস্যবিষয়ক সম্পাদক আসলাম হোসেনকে পুলিশের পরিচয়ে ধরে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন কোনাবাড়ী বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বাবুল হোসেন।
এদিকে বিএনপি নেতাদের নামে রাজধানীর তুরাগ থানার বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের একটি পুরোনো মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা কামালকে কারাগারে পাঠানো হয়। গত শনিবার রাতে সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা কামালকে টঙ্গীর বড় দেওড়া পরান মণ্ডলের টেকের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় বলে দাবি করেছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। এর আগে নির্বাচনী প্রচারকালে গাজীপুর মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি আরিফ হোসেন হাওলাদার, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মো. শওকত হোসেন সরকার, মহানগর বিএনপি নেতা মাহবুবুল আলম শুক্কুর, জিএস জিয়াউল হাসান স্বপনসহ বিএনপির একাধিক নেতাকর্মীর বাসায় কয়েক দফা পুলিশ তল্লাশি চালায়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনেও বিএনপি প্রার্থীর অনেক এজেন্টকে ভোটের দিন সকালে পুলিশ ধরে অন্য জেলায় নিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল। তাঁদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোনও রেখে দেওয়া হয়েছিল, যাতে ভোট শেষ হওয়ার আগে তাঁরা এলাকায় ফিরতে না পারেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ ইব্রাহিম খান বলেন, জিএমপির পক্ষ থেকে কোনো ধরনের অভিযান চালানো হয়নি। কাউকে আটক করা বা কারও বাড়িতে তল্লাশির খবর আমার জানা নেই। কেউ নিখোঁজ রয়েছেন– এমন অভিযোগও আমাদের কাছে কেউ করেননি। নির্বাচনী পরিবেশ অত্যন্ত ভালো: ইসি আলমগীর ঢাকায় নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের কাছে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, শুরুর দিকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলেও মন্ত্রী-এমপিদের সতর্ক করা এবং নৌকার প্রার্থীকে তলবের মধ্য দিয়ে তা সামাল দেওয়া গেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের প্রচারে বাধা ও হামলার অভিযোগ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার বলেন, অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে প্রচার চলছে। মেইন স্ট্রিমের মিডিয়ায় গাড়ি ভাঙচুরের কোনো ভিডিও আসেনি। কোনো পত্রিকাতেও লেখা হয়নি। তিনি নিজে গাজীপুর গিয়েছিলেন উল্লেখ করে এ কমিশনার বলেন, অত্যন্ত সুন্দরভাবে প্রচার হচ্ছে। গাজীপুর সিটি নির্বাচন পরিস্থিতি কমিশনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এ নির্বাচন কমিশনার জানান, ভোটের দিন ৫৭ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। প্রত্যেক ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে বিজিবির টিম থাকবে, র্যাব থাকবে, বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। তিনি বলেন, এর পরও নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার তো কোনো কারণ নেই। ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে যাক। তারপর যদি কেউ বাধা দেয় তখন বলুক। কঠিন অ্যাকশন হবে। গাজীপুরে মিটিংয়ে স্ট্রেইট বলা হয়েছে– কোনো ভোটার কিংবা এজেন্টকে কোনো রকম বাধা দিলে তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন হবে, সে যে-ই হোক।
মো. আলমগীর বলেন, প্রতিটি বুথে সিসি ক্যামেরা থাকবে। ঢাকায় বসে সিইসিসহ অন্য কমিশনার, কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকরা তা পর্যবেক্ষণ করবেন। আমরা কোনো অভিযোগ দেখলে আইনে যেভাবে অ্যাকশন নেওয়ার কথা সেভাবেই নেব। গাইবান্ধায় তো কেবল নির্বাচন বন্ধ করা হয়েছে। এখানে তার চাইতেও কঠিন অ্যাকশন হবে। আপনারা দেখেন।
মন্তব্য করুন