- সারাদেশ
- সারি সারি তাল গাছের গ্রাম কাকিলাদহ
সারি সারি তাল গাছের গ্রাম কাকিলাদহ

মিরপুরের কাকিলাদহ গ্রামে তালের রস সংগ্রহ করতে গাছে উঠছেন এক গাছী-সমকাল
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা বাজার। কুষ্টিয়া-মেহেরপুর মহাসড়কের পাশেই অবস্থিত এলাকার ঐতিহ্যবাহী বাজার এটি। এ বাজার থেকে বাঁ দিকের সড়ক ধরে ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার ভেতরে গেলেই সড়কের দু’ধারে চোখে পড়বে সারি সারি তালগাছ। শুধু সড়কেই নয়, এলাকার পথে, মাঠ-ঘাটে যেদিকে চোখ যায় শুধুই তালগাছ চোখে পড়বে। তালগাছের এ গ্রামটি সদরপুর ইউনিয়নের কাকিলাদহ। প্রখ্যাত বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পালের গ্রাম হিসেবেও চেনেন অনেকে।
তালগাছ ঘিরে গরমকালের চার মাস এ এলাকার অর্থনীতিতে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা যোগ হয়। বাড়তি মুনাফা করেন এলাকাবাসী। কাঁচা তাল, তালের রস, পাকা তাল, তালের গাছ ও পাতা বিক্রি করে আয় করেন তাঁরা। তালের রস বিক্রি করেই সংসার চালাচ্ছেন প্রায় দেড়শ পরিবার। সুস্বাদু তালের রস খেতে প্রতিদিন ভিড় করেন বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজন।
গত ১২ মে কাকিলাদহ গ্রামে গিয়ে গাছ থেকে তাল রস সংগ্রহ প্রক্রিয়া, রস বিক্রিসহ অন্যান্য কার্যক্রম ঘুরে দেখা হয়।
এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি ইমাম আলী। তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে তালগাছ কেটে রস সংগ্রহ করেন। সকাল-বিকেল দু’বেলা তিনি রস সংগ্রহ করেন। প্রতিদিন দুটি গাছ থেকে তিনি পান ৩০ লিটার মিষ্টি রস। এসব রস নিয়ে আসেন স্থানীয় সড়কে। বিকেলে এ সড়কে নানা স্থান থেকে লোকজন আসেন রস খেতে। বিকেল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত মানুষের ভিড় থাকে। এ সময় ইমাম আলীর মতো অনেক গাছি রস নিয়ে আসেন ওই স্থানে। প্রতি গ্লাস রস বিক্রি হয় ১০ টাকায়। এক লিটার নিলে ৫০ টাকা।
ইমাম আলী বলেন, গরমের চার মাস তালগাছ কেটে রস সংগ্রহ করেন। প্রতিদিন ৩০ লিটার রস পান দুটি গাছ থেকে। ৫০ টাকা লিটার হিসাবে প্রতিদিন ১ হাজার ৫০০ টাকা আয় করেন। পাঁচজনের সংসার চালানোর পাশাপাশি অতিরিক্ত টাকা জমাতে পারেন তিনি।
কাকিলাদহ গ্রামের জজপাড়ার সুন্নত আলী বলেন, তাঁদের গ্রামে প্রথম তালগাছ রোপণ করেন দাউদ আলী। তিনি প্রায় ৭০ বছর আগে এলাকার বেশ কয়েকটি সড়ক ও নিজের জমিতে তালগাছ রোপণ করেন। এর পর তাঁর দেখাদেখি এলাকার সব মানুষ তালগাছ রোপণ শুরু করেন। এভাবে কাকিলাদহ গ্রামটি পরিণত হয় তালগাছের গ্রামে। গ্রামটিতে ১৫ হাজারের বেশি তালগাছ আছে।
তালগাছকে কেন্দ্র করে এলাকার মানুষ গরমকালের এ সময়টাতে বাড়তি আয় করেন। এর সঙ্গে জড়িত প্রায় ১০০ থেকে দেড়শ পরিবার।
তালের রস ব্যবসায়ী আক্কাস আলী ও শওকত আলী বলেন, তালগাছ থেকেও যে লাখ লাখ টাকা আয় করা যায় তার উদাহরণ তাঁদের গ্রাম। এলাকার অনেক পরিবার গরমের এ সময় রস, কাঁচা তাল, পাকা তাল ও তাল পাতা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার লিটার রস উৎপাদন হয়। যেসব রস অনেক সময় বিক্রি হয় না, তা দিয়ে তালের গুড় ও পাটালি তৈরি করা হয়।
যেসব জমিতে তালগাছ আছে, সেসব জমির মালিকরা তালগাছ বর্গা দেন কয়েক মাসের জন্য। এ সময় গাছপ্রতি ১ হাজার টাকা পান তাঁরা।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থেকে রস খেতে আসা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, তিনি মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে রস ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। রস ব্যবসায়ীরা রস রেখে দেন। এখানকার রস সুস্বাদু, তাই বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে এসেছেন।
বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পাল মডেল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা রফিকুল ইসলাম বলেন, এ এলাকায় প্রতিবছর তাল রোপণ করা হচ্ছে। রোপণ করলেই গাছ হয়ে যায়, তেমন পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। এলাকার অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে তালগাছ। প্রচুর পর্যটকও আসছেন প্রতিদিন। এ ছাড়া তালগাছের কারণে এলাকায় বজ্রপাত হলে কোনো মানুষ মারা যায় না।
কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আহসান কবির রানা বলেন, বজ্রপাত সাধারণত উঁচু জিনিসের ওপর হয়। তাই যেখানে তালগাছ বেশি সেখানে বজ্রপাত তালগাছের ওপর হবে এটাই স্বাভাবিক। আগে দেশে প্রচুর তালগাছ ছিল, তাই বজ্রপাতে মানুষ মারা যেত কম। আবারও দেশজুড়ে তালবীজ রোপণ করা যেতে পারে।
মন্তব্য করুন