- সারাদেশ
- থিয়েটারের ‘লাভ লেটার্স’
থিয়েটারের ‘লাভ লেটার্স’

‘লাভ লেটার্স’– এ ফেরদৌসী মজুমদার
থিয়েটারের নবতম প্রযোজনা। সেদিনের সন্ধ্যায় মঞ্চ থেকে মৃদুমন্দ সংলাপে শুনেছি কালের যাত্রার ধ্বনি। উঠতি তারুণ্যের অবলা অনুরাগে পথপরিক্রমা শেষে জীবনাবসানের লগ্নের দিকে এগিয়ে যাওয়া দুটি মানুষ তাদের চিঠির ভাষ্যে সবাইকে মুগ্ধ করে রেখেছিল। আমার সঙ্গে যাঁরা সহদর্শক ছিলেন, সবার চোখে-মুখের ভাষায় এবং অভিব্যক্ত প্রতিক্রিয়ায় তৃপ্তির নিখাদ আনন্দ দেখেছি। কিন্তু কেন জানি না, থিয়েটারের এই প্রযোজনা, যার নাট্যকার কিনা উত্তর আমেরিকার অধিবাসী, তা দেখে আমার মনের মধ্যে রবিঠাকুরের নানা গানের সবটা নয়, কিন্তু অনেক চেনা পঙ্ক্তির কথা মনে পড়ছিল। আহা, এই নাট্যাভিনয়ের পরিকল্পনাটাই একটা জুটির বড় থেকে বুড়ো হাওয়ার কাহিনির মধ্য সীমাবদ্ধ, না হলে নিচু স্বরে কেউ তো মাইশা নামের ওই নারীকে শুনিয়ে দিতে পারত– ‘জীবনে পরম লগন... কোরো না হেলা হে গরবিনী’। অথবা যখন প্রৌঢ়ার প্রাণ কাঁদছে, অনন্ত এখন আর তাঁর সঙ্গে সাংসারিক যুগলবন্দি রচনা করতে চায় না, তখন আবছা আঁধারে বসে থাকা মেয়েটি যাকে নির্দেশক ‘সহকারী’ বলে চিহ্নিত করেছেন, সে তো আদুরে অভিজাত কন্যাকে ‘মায়ার খেলা’র প্রমদার মতো শুনিয়ে দিতে পারত– ‘এ তো খেলা নয়, খেলা নয়’।
না, রবীন্দ্রনাথের এই প্রেমভাবনার দখলদারিত্ব থেকে জোর খাটিয়ে মুক্ত হতেই হবে। মূল নাট্যকার অ্যালবার্ট র্যামসডেল গার্নির কাছে ফেরা দরকার। পাঠাভিনয় দিয়ে দর্শককে মশগুল করে রাখার তাঁর শিল্পকৌশলে যে যাদুকরী একটা আবহ আছে, সে কথা তো অনস্বীকার্য। মাত্র দুটো চরিত্র, নারী-পুরুষ, ন্যাকামি করে না, হ্যাংলামো করে না, সামান্য যে খুনসুটি সেও স্বল্পায়ু, নারীর স্পষ্টবাদিতার বিপরীতে পুরুষের আকাঙ্ক্ষার সুভদ্র উচ্চারণ, সব মিলিয়ে নাটকের চেনা দ্বন্দ্ব, যেটাকে বার্নার্ড শ অপরিহার্য গণ্য করেছেন, থিয়েটারের এই প্রযোজনায় প্রেমপত্র নেই, থুড়ি অনুবাদক ও নির্দেশক এই বাংলাভূমিতে রূপান্তরিত চিত্রনাট্যে মূল নাম ‘লাভ লেটার’-ই ব্যবহার করেছেন, ভালোই করেছেন, বাংলা শব্দটায় কেমন যেন আবেগের ঝোঁক থাকে বেশি।
নাটক এমনই হতে পারে পাঠাভিনয়ের মধ্যে এক ধরনের উচ্ছ্বাসরহিত সংলাপ থাকে। তাল লয় যেন বাঁধা থাকে। তবে আহ্লাদ আর আবদারে বেড়ে ওঠা মাইশা অবশ্য সারাটা সময় বসে বসে প্রেমপত্র পাঠ করলেও মুখভঙ্গির সুদক্ষ প্রয়োগে পত্রের শব্দ অতিরিক্ত অভিব্যক্তি প্রদর্শন করেছেন। চরিত্রায়ণ তা দাবিও করে। আর অনন্ত, জীবনশৃঙ্খলা আর মাত্রাকে যে সব সময় দায় দেয়, সে যে মাইশার প্রশ্রয়প্রবণ ভঙ্গিমার বিপরীতে অনড় অটল থাকছেন; সেটাও এই নাটকের নন্দনবোধকে সমৃদ্ধ করেছে। এমনই তো হওয়ার কথা। মঞ্চে অভিনয় করছেন দেশের প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ দুই নট-নটী– ফেরদৌসী ও রামেন্দু মজুমদার। আর নির্দেশনা দিয়েছেন তাঁদের গুণবতী কন্যা, যিনি অবশ্য তা স্বগুণেই আমাদের প্রশংসার দাবি করেছেন, পেয়েছেন বেশ ক’বছর আগে থেকেই ত্রপা মজুমদার। তাঁকে আবারও প্রাণখোলা অভিনন্দন। ফেরদৌসী কেমন অভিনয় করলেন, শুধু বলন দিয়ে, অচলন একটা কেদারায় বসে, তা পাঠকদের না জানলেও চলবে। তাঁর জাতটা সবাই জানেন। তবে এখানে তো তিনি জীবনের ক্লান্ত পথিক, শুধু সংলাপ আর পোশাকের সামান্য হেরফের ও কেশসজ্জার পুনর্বিন্যাসকে পুঁজি করে দর্শকদের কাছে ভাবমূর্তি অক্ষত রাখতে হবে। পাঠক, নাটক না দেখেও আপনি হাততালি দিন। মাইশাকে, যে কিনা লাহোরে পড়তে যায়, প্যারিসে চিত্র প্রদর্শনী করে, আজ জীবনের পড়ন্ত বেলায় জীবনখাতার প্রতি পাতায় যতই হিসাবনিকাশের বিবরণী আবৃত্তি করুন না কেন, এবং তাঁর সক্ষমতার যতই নিদর্শন রাখুন না কেন, মনে পড়ে যাচ্ছিল তাঁর মঞ্চ কাঁপানো অভিনয়ের কথা। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ অথবা ‘এখনও ক্রীতদাস’ প্রদর্শনী শেষে কথা হচ্ছিল এই কালের এক দক্ষ নির্দেশকের সঙ্গে। রামেন্দু মজুমদার, আমাদের মঞ্চনাটক নিয়ে কথা বলতে যাঁর নাম অনিবার্যভাবে উচ্চারণ করতেই হয়, যদিও প্রায়ই মুখ্য ভূমিকার অভিনেতা নন। আবদুস সেলিম চমৎকার অনুবাদ/রূপান্তর করেছেন। ২০১৭-এ আলী যাকেরকে পড়ে শুনিয়েছিলেন, ঘষামাজা বা উৎকর্ষ বর্ধনের সময় পাওয়া গেছে। ত্রপা হয়তোবা প্রযোজনার প্রয়োজনে উক্তিমালার পরিমার্জন করেছেন। শুধু অনন্তের মুক্তিযুদ্ধকালীন কথায় তৎসব শব্দের ভারটাকে মাইশাকে পাঠানো চিঠির জন্য একটু ভারী মনে হয়েছে। মূল নাটকের সেলিসাকে মাইশা আর অ্যান্ডুকে অনন্ত হিসেবে পুনঃস্থাপন ভালো লেগেছে। তবে এই যে ত্রপা, ওর মধ্যে মাঘের শীত তাড়ানো আগুন আছে। এই প্রযোজনায় গান, আবহসুর, কালের যাত্রার [ঘণ্টা] ধ্বনি, মঞ্চের পেছনে চিত্র প্রক্ষেপণ– এসবের মধ্যে এমন আন্তরিক মুন্সিয়ানা যা অভিভূত করেছে আমাকে। চিঠির শব্দধৃত কুকুর দৃশ্যমান হয়েছে, এমনকি রাজনৈতিক আন্দোলন মঞ্চের আলোকে নিয়ন্ত্রণ করে পোশাক পরিবর্তনের মধ্যে শিল্পের ভাবনা আছে। দু’জন সহকারী যুগল নৃত্যেও মাইশা-অনন্তের যৌবনকে মূর্ত করে তুলেছে। নাটকের শুরু আর শেষে অভিনেতাদের দিয়ে যা করিয়েছেন, তাতে তার পরিণত নন্দনচিন্তার পরিচয় পেয়েছি।
মন্তব্য করুন