- সারাদেশ
- খেলাপি ঋণের অর্থ উদ্ধারে কঠোর অবস্থানে আদালত
খেলাপি ঋণের অর্থ উদ্ধারে কঠোর অবস্থানে আদালত

চট্টগ্রামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন আদালত। চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত সূত্র জানিয়েছে, যুগ্ম জেলা জজ মুজাহিদুর রহমানের কড়া পদক্ষেপের ফলে গত দুই বছরে ৬২২ ঋণখেলাপি অন্তত ১ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য হয়েছেন। এ ছাড়া ঋণের টাকা মেরে দিয়ে বিদেশে পালানো খেলাপিদেরও দেশে ফিরিয়ে আনতে আদালত নির্দেশ দিয়েছেন। মাত্র ১২ দিনের ব্যবধানে সর্বশেষ গত ৯ এবং ২১ মে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত দুবাই ও কানাডায় পালিয়ে যাওয়া দুই শীর্ষ ঋণখেলাপিকে দেশে ফেরাতে কঠোর নির্দেশ দেন। তাঁদের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানাও ইস্যু করা হয়েছে। আইনজীবীরা বলছেন, সরকার আন্তরিক হলে ও পুলিশ চাইলে ইন্টারপোলের মাধ্যমে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ঋণখেলাপিদের দেশে ফেরানো সম্ভব।
সর্বশেষ গত ২৩ মে ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ পরিশোধ করে জামিন পান চট্টগ্রামের মেসার্স এম এস অটোমোবাইলসের মালিক মো. মহিউদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী জুনুফার রায়হান। ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত সাত বছর ধরে ১১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পরিশোধ করছিলেন না তাঁরা। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আদালত এ দম্পতির বিরুদ্ধে পাঁচ মাস করে দেওয়ানি আটকাদেশ দিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করেন। এর পরই ঋণের টাকা পরিশোধে ওই দম্পতির টনক নড়ে। জামিনকালে তাঁরা খেলাপি ঋণের বাকি টাকাও ফেরতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁদের মতো অন্য ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধেও দুই বছর ধরে একের পর এক সাজা পরোয়ানা জারি, দেওয়ানি সাজা, রিসিভার নিয়োগ, দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা ও পাসপোর্ট জব্দের মতো কড়া পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন আদালত।
ওয়ান ব্যাংক জুবলি রোড শাখার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জুয়েল দাশ বলেন, ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ না করে বাদশা গ্রুপের এমডি ইছা বাদশা ওরফে মহসিন কানাডা পালিয়ে গেছেন বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। আমরা অর্থঋণ আদালতে হলফনামা দিয়ে তাঁকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে এনে টাকা আদায়ের আবেদন করি। গত ৯ মে শুনানি শেষে আদালত ওই ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন এবং তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনতে অর্থ সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে নির্দেশ দেন।
আদালত সূত্র জানায়, ইছা বাদশার বিরুদ্ধে ইস্টার্ন ব্যাংকসহ আরও ব্যাংকের অন্তত পাঁচটি অর্থঋণ মামলা চলমান রয়েছে। এসব মামলায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি।
একইভাবে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণখেলাপি ইমাম গ্রুপের এমডি মোহাম্মদ আলী ও তাঁর স্ত্রী জেবুন্নেছা আকতারকে দুবাই থেকে দেশে ফেরাতে গত ২১ মে নির্দেশ দেন চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের যুগ্ম জেলা জজ মুজাহিদুর রহমান। তাঁদের বিরুদ্ধে ৫ মাস করে ১০ মাসের সাজা পরোয়ানা ইস্যু করা হয়। সোনালী ব্যাংকের চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ শাখার করা ১৮৪ কোটির খেলাপি ঋণ মামলায় আদালত এ আদেশ দেন। এই ব্যবসায়ী দম্পতি গত ১১ বছরে ব্যাংকের কোনো পাওনা পরিশোধ করেননি। ব্যাংকের হলফনামায় জানানো হয়, মোহাম্মদ আলী ও তাঁর স্ত্রী জেবুন্নেছা বর্তমানে গোল্ডেন ভিসা নিয়ে দুবাইতে বসবাস করছেন। দেশ থেকে পাচার করা অর্থ নিয়ে দুবাইতে তাঁরা নানা ব্যবসা-বাণিজ্যে করেছেন বিনিয়োগ। তাঁদের বিরুদ্ধে ১৫টি খেলাপি ঋণের মামলা চলমান।
চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম বলেন, সোনালী ও ওয়ান ব্যাংক হলফনামা দিয়ে জানায়, শীর্ষ দুই ঋণখেলাপি বিদেশে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। গত ৯ ও ২১ মে আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান পুলিশ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের অভিযুক্ত ঋণখেলাপিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে নির্দেশ দেন। বিদেশে পালানো ঋণখেলাপিদের ফিরিয়ে আনতে এর আগে কখনও এমন কড়া আদেশ দেওয়া হয়নি।
একাধিক ব্যাংকের আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান বলেন, সাজা পরোয়ানা থাকা ঋণখেলাপিদের ইন্টারপোলের সহযোগিতায় বিদেশ থেকে দেশে ফেরানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকার ও পুলিশকে আন্তরিক হতে হবে। ঋণখেলাপিদের বিদেশ থেকে ফেরাতে পারলে ব্যাংক খাতে লুটপাট বহুলাংশে কমে যাবে।
বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন চট্টগ্রামের যেসব ঋণখেলাপি
বিভিন্ন ব্যাংক এবং চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত সূত্র জানায়, ঋণের শত শত কোটি টাকা মেরে দিয়ে কানাডা, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও আরব আমিরাতে পাড়ি দিয়েছেন দুই ডজনের বেশি ব্যবসায়ী। তাঁদের মধ্যে ইমাম গ্রুপের মোহাম্মদ আলী, বাদশা গ্রুপের ইশা বাদশা ছাড়াও ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা মেরে কানাডায় পাড়ি দিয়েছেন মোস্তফা গ্রুপের এমডি জহির উদ্দিন। ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণখেলাপি মিশম্যাক গ্রুপের মালিক মিজানুর রহমান শাহীন ও হুমায়ুন কবির সপরিবারে পালিয়েছেন কানাডায়। ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণখেলাপি ইয়াছির এন্টারপ্রাইজের মালিক মোজাহের হোসেনও সপরিবারে কানাডা পাড়ি দিয়েছেন। ১২ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকার বেশি ঋণখেলাপি ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী তিন ভাই জয়নাল আবেদিন, জামিল আবেদিন ও মোহাম্মদ আলাউদ্দিন পাড়ি জমিয়েছেন কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে। ৮০০ কোটি টাকা ঋণখেলাপি ক্রিস্টাল গ্রুপের মালিক কানিজ ফাতিমা রাশেদ ও তাঁর স্বামী রাশেদ মুরাদ ইব্রাহিমও আছেন কানাডায়। ৬০০ কোটি টাকার ঋণখেলাপি সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকার ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন কুসুম এবং ৫২৫ কোটি টাকা ঋণখেলাপি লিজেন্ড হোল্ডিংসের মালিক এস এম আবদুল হাইও কানাডা চলে গেছেন।
এ ছাড়া ছয় ব্যাংকের ৪০০ কোটি টাকা ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী আবদুল আলিম চৌধুরী পালিয়েছেন ইউরোপের দেশ মন্টেনিগ্রোতে। ৩০০ কোটি টাকা ঋণখেলাপি আরেক ব্যবসায়ী নাজমুল আবেদিন আছেন লন্ডনে। এ ছাড়া ৩০০ কোটি টাকা ঋণখেলাপি খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী শাহ আলম কানাডায়, ২৮০ কোটি টাকা ঋণখেলাপি মোহাম্মদ মোরশেদ যুক্তরাষ্ট্রে, ২০০ কোটি টাকা ঋণখেলাপি মাকসুদুল আলম অস্ট্রেলিয়ায়, ১৮৬ কোটি টাকার ঋণখেলাপি জাহিদ এন্টারপ্রাইজের মালিক জাহিদ হোসেন মালয়েশিয়ায়, ১৫০ কোটি ঋণখেলাপি বাগদাদ গ্রুপের মালিক ফেরদৌস খান আলমগীর সপরিবারে কানাডা, শতকোটি টাকা ঋণখেলাপি ইফফাত ইন্টারন্যাশনালের মালিক দিদারুল আলম কানাডায়, ৭১ কোটি টাকা ঋণখেলাপি আনোয়ারুল হক চৌধুরী মালয়েশিয়ায়, ৬৭ কোটি টাকা ঋণখেলাপি এন এম ট্রেডিং করপোরেশনের মালিক এস এম শামীম ইকবাল কানাডায়, ২০ কোটি টাকার ঋণখেলাপি খাতুনগঞ্জের এস এল এন্টারপ্রাইজের মালিক লেয়াকত আলী চৌধুরী লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছেন।
মন্তব্য করুন