‘বয়স হয়ে গেছে। এই বয়সে মেশিনে ভোট দিলাম। প্রথমে বুঝতে কষ্ট হয়েছে। এরপর কীভাবে মেশিনে ভোট দিতে হবে কয়েকবার স্যাররা শেখাল। এরপর শর্টকাট টিপ মারছি। মেশিনে ভোট দিতে পেরে কী যে আনন্দ লাগছে!’– এমন অনুভূতি মরিয়ম বেগমের। গাজীপুরের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডে টঙ্গীর এরশাদনগরের শহীদ আহ্‌সান উল্লাহ্‌ স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন তিনি। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ভোটের অঙ্কে টঙ্গী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গতকাল সকাল থেকেই কেন্দ্রে স্বতঃস্ফূর্ত হাজির হয়েছেন নানা শ্রেণি-পেশার ভোটার। টঙ্গীর বিভিন্ন কেন্দ্রের ভোটারের দীর্ঘ লাইন থাকায় ৪টারও পর ভোট নিতে হয়েছে।

ভোটের মাঠে এরশাদনগরের মরিয়ম যেভাবে জীবনে প্রথম ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট দিয়ে খুশি, তেমনি আছে আক্ষেপের গল্পও। এ গল্পের কুশীলব অশীতিপর আছিয়া খাতুন। বিকেল ৪টার দিকে আছিয়া যখন হৃদয়ে দহন নিয়ে টঙ্গীর দত্তপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র ছাড়ছিলেন তখন তাঁর মুখে বিরক্তির রেখা! হাঁপাতে হাঁপাতে আছিয়া বলছিলেন– ‘এক ঘণ্টা চেষ্টা করেও ভোট দিতে পারিনি। বয়স হয়ে যাওয়ায় আঙুলের রেখা পাওয়া যায়নি। কী আর করা! সবাই খুশি মনে ভোট দিল। আমি খালি হাতে বাসায় ফিরছি।’ পাশে থাকা আনসার সদস্য রেজাউলও বললেন, ‘অনেক চেষ্টা করেও হাতের ছাপ নিতে না পারায় এ বৃদ্ধা ভোট দিতে পারেননি।’

ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে ৭টা; টঙ্গীর দারুস সালাম মাদ্রাসা।

ভোট শুরুর আগেই ওই কেন্দ্রে লম্বা সারি। মাদ্রাসার মূল ফটক ছাড়িয়ে লাইনের শেষ প্রান্ত অনেক দূর পর্যন্ত এঁকেবেঁকে গেছে। এটি নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খানের কেন্দ্র। ৮টা ৫ মিনিটের দিকে ওই কেন্দ্রে ভোটার ঢুকতে শুরু করেন। তবে শুরুতে সেখানকার ৮ বুথের মধ্যে দুটিতে ইভিএমে জটিলতা দেখা দেয়। ৮টা ৫৫ মিনিটে ভোট দিতে আসেন আজমত উল্লা। ‘বিজয়’ চিহ্ন দেখিয়ে কেন্দ্রে ঢোকেন তিনি। এরপর সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। আজমত বলেন, ‘সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ চলছে।
নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। জনগণের সঙ্গে ছিলাম। জনগণও আমার সঙ্গে আছে।’ দারুস সালাম মাদ্রাসা কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার জাকির হাসান তালুকদার বলেন, একটি বুথে কারিগরি ত্রুটি এবং আরেক বুথে এক ভোটারের পায়ে বেঁধে তার খুলে যাওয়ার কিছু সময় ভোট গ্রহণে বিঘ্ন হয়েছে। পরে সেই ত্রুটি সারিয়ে তোলা হয়েছে।

টঙ্গীর বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, সকাল থেকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটারে ভরপুর। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিচ্ছেন নারী-পুরুষ। তবে টঙ্গীর প্রায় সব কেন্দ্রে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনের টেবিল ঘড়ি প্রতীকের এজেন্ট খুঁজে পাওয়া যায়নি। সব কেন্দ্রে নৌকা ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী গাজী আতিকুর রহমানের হাতপাখা প্রতীকের এজেন্ট ছিলেন।

টঙ্গীর ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের আউচপাড়া ঘুরে দেখা যায়, মামদী মোল্লা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। ওই ওয়ার্ডের সব মিলিয়ে কাউন্সিলর প্রার্থী ৫ জন। তবে নির্বাচনী মাঠে চাচা-ভাতিজার মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। চাচা বিল্লাল হোসেন মোল্লার সঙ্গে ভাতিজা নাসির হোসেন মোল্লার লড়াই অন্যরকম আবহ তৈরি করে। নাসির সমকালকে বলেন, ‘জয়-পরাজয় যা হোক মেনে নেব। নির্বাচন আর পারিবারিক সম্পর্ক আলাদা বিষয়।’ তবে শেষ পর্যন্ত চাচা বিল্লাল হোসেন কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। মামদী মোল্লা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ছেলেমেয়েকে নিয়ে ভোট দিতে আসেন মো. আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘ভোট দিয়ে দারুণ খুশি। ছেলে এবারই প্রথম ভোট দিল।’ আখতারুজ্জামানের ছেলে হাসিবুল হোসেন বলেন, ‘প্রথমবারের মতো ভোট দিলাম। এটা অন্যরকম ভালোলাগার বিষয়।’

টঙ্গীর এরশাদনগর ঘুরে দেখা যায়, আশপাশের সব কেন্দ্রে ভোটারদের সরব উপস্থিতি। মামদী মোল্যা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে তাসকারা বেগম নামে এক প্রতিবন্ধীর স্বজনের সঙ্গে কথা হলো। তাসকারার ভাতিজি জামাই ফুলমিয়া সমকালকে বলেন, তাসকারা বাক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী। ভোট দেওয়ার ব্যাপারে প্রচণ্ড আগ্রহ থাকায় তাঁকে কেন্দ্রে আনা হয়েছে। হেনোয়ারা বেগম নামে আরেক ভোটার বলেন, ‘বুথে ঢোকার আগে হ্যারা যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছে সেইভাবে টিপ দিয়েছি। আমি তো একেবাবে অশিক্ষিত না।’ 

আলমাস উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা পোশাককর্মী শাহিদা বেগম বলেন, ‘দেড় ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে পেরেছি। নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরে অত্যন্ত খুশি।’

টঙ্গীর ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডে আজমত উল্লা খানের বাড়ি। একই ওয়ার্ডে বাস করেন হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমানও। স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম রনির বাড়িও টঙ্গীতে। টঙ্গীতে সিটির ১৫টি ওয়ার্ড। এখানে ভোটার ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৯৫২, যা মোট ভোটারের প্রায় ৩৫ শতাংশ। সাবেক টঙ্গী পৌরসভায় প্রায় ১৮ বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন আজমত উল্লা খান। প্রচারণায় সিটির অন্য এলাকার চেয়ে বেশি সময় দিয়েছেন টঙ্গীতে। টঙ্গীর বেশিরভাগ ভোটই আজমত উল্লা খানের বলে দাবি করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। রনি সরকারের বাড়ি টঙ্গী এলাকার ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডে। প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য হওয়ায় রনি সরকার বংশীয় ভোট পাবেন। জায়েদা খাতুনের টেবিল ঘড়ি প্রতীকে টঙ্গীর ভোট নেওয়ার জন্য কাজ করেছেন জাহাঙ্গীর। ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কানাইয়া এলাকায় জাহাঙ্গীরের পৈতৃক ভিটা হলেও তিনি বাস করেন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে মহানগরের ছয়দানা এলাকায় ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে। বিসিক শিল্প এলাকায় হওয়ায় টঙ্গীতে প্রচুর শ্রমিকের বাস, যাদের বড় অংশই ভোটার। আবার টঙ্গী এলাকায় ছোটবড় কমবেশি ১৯টি বস্তি রয়েছে। এসব বস্তির বাসিন্দারাও ভোটার। বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে পোশাক শ্রমিকদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।