শুরু থেকে যে কয়েকটি কারণে এবার গাজীপুর সিটি নির্বাচন জমে উঠেছিল, এর অন্যতম কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ৫৭ ওয়ার্ডে মোট কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন ২৪৬ জন। আর সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী ৭৬ জন। কেন্দ্রে ভোটারদের সরব উপস্থিতির পেছনে কাউন্সিলর প্রার্থীর জয়ী হওয়ার ব্যাপারে মরিয়া মনোভাবকে অন্যতম অনুঘটক মনে করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর বাইরেও বিএনপির ২৯ নেতাকর্মী কাউন্সিলর পদে লড়েছেন। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে তাঁরা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী লড়াইয়ে ছিলেন।

একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী জানান, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর মধ্যে যাঁরা কাউন্সিলর পদে লড়েছেন, তাঁরা সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে দুই কারণে বেশি তৎপর ছিলেন। প্রথমত, নিজের বিজয় নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, নৌকার মেয়র প্রার্থীকে জেতানো। এ ছাড়া কাউন্সিলরদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন আগে থেকেই সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমপন্থি। দল থেকে বহিষ্কারের পর তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ জাহাঙ্গীরের সঙ্গ ছাড়েন। আবার অনেকে গোপনে তাঁর সঙ্গে সখ্য রাখেন।

গাজীপুর সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বস্তিবাসী, নিম্ন আয়ের মানুষ ও বিভিন্ন শিল্পকারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের কদর বেড়ে যায়।

মেয়র প্রার্থীদের কাছে তাঁরা খুব বেশি পাত্তা না পেলেও কাউন্সিলর প্রার্থীরদের কাছে অর্থ ও সম্মান দুইই পেয়েছেন। নির্বাচনের মাঠে কাউন্সিলর প্রার্থীদের দেওয়া কদর শেষ দিন পর্যন্ত রেখেছেন সিটি করপোরেশনের ৫৭ ওয়ার্ডের ওই শ্রেণীপেশার ভোটার। সে প্রমাণ মিলেছে ৪৮০ কেন্দ্রেই। এ নির্বাচনে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি আগের যে কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। কেন্দ্রগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে কাউন্সিলর প্রার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বেলা ১১টায় মহানগরের সালনা নাসির উদ্দিন মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে নারী-পুরুষ ভোটাররা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। ইভিএমে ভোট দেওয়ার বিষয়টি বুঝতে না পারায় ভোট নেওয়া হয় ধীরগতিতে। আলমাস আলী নামে চল্লিশোর্ধ্ব এক ভোটার বলেন, ‘শরীরটা ভালো না। ভোট দিতে আসতে চাইছিলাম না। তবে বিবেকের তাড়নায় এসেছি। একটা ভোটের জন্য একজন কাউন্সিলর প্রার্থী আমার বাড়িতে তিন দিন গিয়েছেন। আমাকে সম্মান দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রে না এসে পারলাম না।’ গাজীপুর শহরের রানী বিলাসমণি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের পুরুষ বুথে ভোটার আয়নাল হক বলেন, ‘একজন কাউন্সিলর প্রার্থীর কাছ থেকে এত সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছি যে তাঁকে ভোট দেওয়ার জন্যই শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রে এসেছি।’ 

আলমাস আলী ও আয়নাল হকের মতো হাজারো ভোটার কেন্দ্রে এসেছিলেন কাউন্সিলর প্রার্থীর ভালোবাসায়। তবে ব্যতিক্রমও আছে। কোনো কোনো এলাকায় কাউন্সিলর প্রার্থীরা ভাসমান প্রতিটি ভোট কিনতে ৫-৬ হাজার টাকা খরচ করেছেন। ভোটাররা প্রার্থীর টাকা হাতে পেয়ে দায় মোচনের জন্য কেন্দ্রে এসেছিলেন। গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় রয়েছে ১৯টি বস্তি। বস্তিবাসীর কাছে পছন্দের চেয়ে অর্থের মূল্যই বেশি ছিল। সারা বছর নিম্ন আয়ের অভাবী এসব মানুষের খোঁজখবর কেউ না নিলেও নির্বাচন ঘিরে তাঁদের সম্মান বেড়ে যায় প্রার্থীদের কাছে। এরশাদনগর, কড়ইতলা, নামা বাজার, কেরানীর টেক, নিশাত, কলাবাগান, নিমতলী, ব্যাংকের মাঠসহ ১৯টি বস্তির ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হন। ১৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত কাউন্সিলর মোসলেম উদ্দিন চৌধুরী মুসা বলেন, ‘ভোটারদের সম্মান দিলে ভোটাররাও সম্মান দেন। তাঁদের সম্মান দিয়েছি বলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁরা কেন্দ্রে গিয়ে আমাকে ভোট দিয়েছেন।’