গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ভুগিয়েছে ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। ইভিএমে ভোট দিতে ধীরগতির কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে ভোটারদের। তবে বেশি ভুগেছেন নারীরা। এরপরও প্রায় প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ছিল ভোটারের ঢল।

গত কয়েক বছরে শহর অঞ্চলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোটের হার ছিল কম। প্রশ্ন ছিল, ভোটাররা নির্বাচনে আস্থা হারাচ্ছেন কিনা। জাতীয় থেকে স্থানীয়– সব নির্বাচনেই ভোটের পরিবেশ ও ফল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সেখান থেকে ব্যতিক্রম গাজীপুরের ভোট। সকাল থেকেই ভোটকেন্দ্রগুলোতে ছিল ভোটারের ভিড়। নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়া যাচ্ছে– এ খবরে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটারের ঢল নামে।

ভোটার বৃদ্ধিতে বাড়ে ইভিএম ভোগান্তি। ইভিএমে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি না জানায় নারী কেন্দ্রগুলোতে একজন ভোটারের ভোট নিতে ১০ মিনিট পর্যন্ত লেগে যায়। বাইরে তৈরি হয় দীর্ঘ সারি। কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএম বিকল হয়ে ভোট গ্রহণ সাময়িক বন্ধেরও খবর পাওয়া গেছে। টঙ্গীর আউচপাড়া এলাকায় নিউ বর্ন স্কুল কেন্দ্রে জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিনের ২৭ মিনিট লাগে ভোট দিতে। বিলম্বের কারণে অনেকেই ফিরে যান ভোট না দিয়ে।

দুপুর ১২টার দিকে কোনাবাড়ীর এমএ কুদ্দুস বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, নারীদের বুথে ভোটারের দীর্ঘ সারি।

চারটি ভোটকক্ষের সারিতে অন্তত শদুয়েক নারী ভোট দেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। সেখানে দেখা হয়, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এ এ এম মোহাম্মদ মুস্তাকিনের সঙ্গে। তিনি নারী ভোটারদের দেখিয়ে দিচ্ছিলেন কীভাবে ভোট দিতে হয়। তিনি জানান, চার ঘণ্টায় ১ নম্বর বুথে ৩২৮ ভোটারের ৬৮ জন এবং ২ নম্বর বুথে সমান সংখ্যক ভোটারের ৭১ জন ভোট দিয়েছেন।

ভোটের গোপন কক্ষে ভোটার ছাড়া অন্য কারও প্রবেশ বেআইনি। কিন্তু দেখা যায়, গোপন কক্ষের পর্দার ওপর দিয়ে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ভোটারদের দেখিয়ে দিচ্ছেন কীভাবে ভোট দিতে হয়। মোহাম্মদ মুস্তাকিন সমকালকে বলেন, ভোটার সহায়তা চাইলে একমাত্র প্রিসাইডিং কর্মকর্তা গোপন বুথ পর্যন্ত গিয়ে সাহায্য করতে পারেন।

তিনি বলেন, অধিকাংশ নারী ভোটার প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম নন। সিটি নির্বাচনে তিনটি পদে ভোট দিতে হয়। ভোটারের আঙুলের ছাপ মেলার পর গোপন কক্ষে বোতাম টিপে ভোট দিতে হয়। তা অনেক ভোটারই বুঝতে পারছেন না। এ কারণেই সময় লাগছে।
গড়ে ছয়-সাত মিনিট লাগছে একজনের ভোট নিতে।

হাতিমারা ভোটকেন্দ্রের নারী ভোটকক্ষের সামনে দুপুর দেড়টার দিকে হাজারো নারীর ভিড় ছিল। নাসিমা বেগম নামের একজন জানালেন, তিনি সকাল ৮টায় এসেছেন। ১ নম্বর বুথের লাইনে দাঁড়ান। সেখানে প্রবেশের পর বলা হয়, তার ভোট ২ নম্বর বুথে। এই বুথে আবার তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হয়।

২ নম্বর বুথের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নুসরাত জাহান সমকালকে বলেন, এই বিলম্ব ইচ্ছাকৃত নয়। অধিকাংশ ভোটার শ্রমজীবী নারী। তাঁরা ইভিএম সম্পর্কে জানেন না। ইভিএমের ব্যালট ইউনিটে প্রতীকের ছবি ছোট করে দেওয়া। বয়স্ক ভোটাররা তা চোখে দেখছেন না।

অনেকেই প্রার্থীর নাম পড়তে পারেন না। সেসব কারণেই সমস্যা হচ্ছে। অনেক ভোটার তিনটি পদের একটিতে ভোট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছেন। এসব কারণেই দেরি হচ্ছে। লম্বা লাইন থাকলে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টায় ২ নম্বর বুথে ৩৬৮ জন ভোটারের মাত্র ৯৮ জন ভোট দেন।

১ নম্বর বুথের অবস্থা ছিল আরও খারাপ। একই সময় ওই বুথে ভোট দেন ৫৮ জন। ওই বুথের গোপন কক্ষে প্রবেশ করেও ভোট না দিয়ে বেরিয়ে আসেন ৭০ বছর বয়সী খোদেজা বেগম। তিনি অসহায় মুখে বলেন, কিছু তো বুঝি না। তাঁকে আবার বোঝানো হলো, কী করে ইভিএমে ভোট দিতে হয়। এতে বুথের বাইরে ভোটারের সারি আরও দীর্ঘ হয়। তবে ২ মিনিট ১৭ সেকেন্ডে ভোট দেওয়া সম্পন্ন কোহিনূর নামে এক তরুণীর। তিনি বললেন, ইভিএমে ভোট দেওয়া সহজ। একটু বুঝলেই হলো।

শুধু নারী নন; বয়স্ক, স্বল্পশিক্ষিত পুরুষ ভোটাররাও ইভিএমে ভোট দিতে ভোগান্তি পোহান। হাতিমারা কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা বৃদ্ধ আজিবর রহমান বলেন, ‘বাও তো কিছুই বুজি না।’ পরে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সহায়তায় ভোট দেন। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মোকারম হোসেন জানান, ভোটাররা ইভিএম সিস্টেম না বোঝার কারণে ভোট গ্রহণে ধীরগতি হচ্ছে। অনিয়ম ছাড়াই ভোট গ্রহণ করা হচ্ছে।

কাশিমপুরের এনায়েতপুরের বাসিন্দা মানছুরা বেগম ও সীমা বেগম দুপুর ১২টার দিকে হাতিমারা কেন্দ্রে আসেন ভোট দিতে। তাঁরা সম্পর্কে শাশুড়ি ও পুত্রবধূ। সীমা বেগমের সঙ্গে ছিল তাঁর দুই সন্তান। কিন্তু দেড় ঘণ্টায় ভোট দিতে না পেরে তাঁরা ফিরে যান। সীমা বেগম জানান, তিনি স্থানীয় ইউসুফ মার্কেটে কাজ করেন। দুই ঘণ্টা ছুটি নিয়ে আসেন ভোট দিতে। কিন্তু না পেরে চলে যাচ্ছেন। মানছুরা বেগম বললেন, বাড়িতে গিয়ে নাতিদের দেখভাল করতে হবে। তাই তাঁরও ভোট দেওয়া হলো না। ইভিএমের কারণেই ভোটাধিকার বঞ্চিত হলেন।