গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটাররা নিজের ভোট নিজে এবং যাঁকে খুশি তাঁকে দিতে পেরেছেন। ভোটের গোপন কক্ষে ছিল না ‘অনাহূত’ কেউ। বিনাবাধায় ভোট দিতে পেরে খুশি ভোটাররা। গতকাল বৃহস্পতিবার গাজীপুর সিটির ১, ৬ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১৪টি কেন্দ্র ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।

গত কয়েক বছরে অনুষ্ঠেয় অধিকাংশ নির্বাচনের তুলনায় এবার ব্যতিক্রমী ভোট হয়েছে এসব কেন্দ্রে। নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়া যাচ্ছে খবরে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ভোটারের ভিড়। ছিল দীর্ঘ সারি, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যায়নি। জ্যৈষ্ঠের গরম ও রোদে ঘণ্টার ঘণ্টার পর অপেক্ষার কষ্ট সয়েও ভোট দিয়ে হাসিমুখে ফিরেছেন ভোটাররা।

কোনাবাড়ীর মোহাম্মদ ইমারত হোসেইন আরিফ কলেজে ছিল দুটি পৃথক ভোটকেন্দ্র। ৬৩ নম্বর কেন্দ্রে সকাল ১০টায় গিয়ে দেখা যায়, ভোটারদের নাতিদীর্ঘ এক সারি। তাতে থাকা ১০-১২ তরুণ জানালেন, অবাধে ভোট দেওয়া যাচ্ছে খবর পেয়ে তাঁরা এসেছেন। ভোট কক্ষে গিয়ে দেখা গেল ঝামেলা ছাড়াই ভোট চলছে। কক্ষে নৌকা প্রার্থী আজমত উল্লা খানসহ অন্য মেয়র প্রার্থীদের এজেন্ট ছিলেন। তবে পাওয়া যায়নি বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা তথা টেবিল ঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী জায়েদা খাতুনের এজেন্টকে। এ কেন্দ্রের ছয়টি ভোট কক্ষের একটিতেও ছিলেন না টেবিল ঘড়ির এজেন্ট। ৬৪ নম্বর কেন্দ্রের ছয়টি বুথের একটিতেও জায়েদা খাতুনের এজেন্ট পাওয়া যায়নি।

প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর একজনের এজেন্ট না থাকলেও ভোটে অনিয়মের চিত্র দেখা যায়নি। ভোট দিয়ে বেরিয়ে আসা তোফাজ্জল মিয়া বললেন, কেন্দ্রে আসতে বাধা ছিল না। গোপন কক্ষে কেউ উঁকিও দেয়নি। নিজের ভোট নিজে দিয়েছেন। যাঁকে খুশি তাঁকে দিয়েছেন।
কেন্দ্রের বাইরে সেই সময়ে বেজে ওঠে বিজিবি গাড়ির সাইরেন। আসেন ভোটের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। কেন্দ্রের ফটকের বাইরে অবস্থান করা নৌকাসহ সব প্রার্থীর সমর্থকদের সরিয়ে দেন। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে কেন্দ্রের ভেতরে বহিরাগতদের অবাধ বিচরণ দেখা গেছে। গতকাল গাজীপুরের ভোটে এ অনিয়ম দেখা যায়নি। প্রার্থী ও তাঁর এজেন্ট ছাড়া কোনো ব্যক্তি কেন্দ্রে ঢুকতে পারেননি। নেতা পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিদেরও কেন্দ্রের সামনে থেকে লাঠি উঁচিয়ে হটিয়ে দেয় পুলিশ-বিজিবি।

আধা-কিলোমিটার দূরে এম এ কুদ্দুস উচ্চ বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়েও ভোটকেন্দ্র ছিল দুটি। ৭১ ও ৭২ কেন্দ্রের ১৮টি ভোট কক্ষের একটিতেও টেবিল ঘড়ির এজেন্ট ছিলেন না। গণফ্রন্টের মাছ প্রতীকের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলামের এজেন্ট ছিলেন প্রতিটি কক্ষে। ভোটের মাঠে তাঁর নামডাক না থাকলেও কী করে সব কেন্দ্রে এজেন্ট দিয়েছেন, তা ছিল এক রহস্য। কিন্তু তাঁর এজেন্টদের সঙ্গে আলাপেই রহস্যের জট খোলাসা হয়।

৭১ নম্বর কেন্দ্রের তিন নম্বর বুথে মাছের এজেন্ট ছিলেন আবদুর রহমান। তিনি প্রার্থী ও দলের নাম বলতে পারলেন না। চার নম্বর বুথের এজেন্ট সাগর হোসেন বললেন, তাঁর প্রার্থীর নাম আতিকুর রহমান এবং দলের নাম যুক্তফ্রন্ট। যদিও প্রার্থীর নাম আতিকুল ইসলাম এবং দলের নাম গণফ্রন্ট। আবদুর রহমান ও সাগর হোসেন স্বীকার করলেন, তাঁরা আসলে গণফ্রন্টের কেউ নন। আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁদের এজেন্ট করেছেন। কিন্তু তাঁরা আজমত উল্লা নাকি আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে কাজ করছেন, তা জানা গেল না।

এজেন্ট যাঁর পক্ষেই কাজ করুন, তাতে অবশ্য সুষ্ঠু ভোটের উনিশ-বিশ হয়নি। ৭১ নম্বর কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার জাকির হোসেন সমকালকে জানালেন, তাঁর কেন্দ্রের ৯টি বুথেই নৌকা ও মাছ এজেন্ট দিয়েছে। টেবিল ঘড়ি একজন এজেন্টও দেয়নি। ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখার প্রার্থী আটজন এজেন্ট দিয়েছেন। জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী দিয়েছেন একজন এজেন্ট। কোনো এজেন্টকে বের করে দেওয়ার বা কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেওয়ার অভিযোগ নেই।

বাংলাদেশে ভোট ছিল উৎসবের নাম। গত কয়েক বছরে তা ফিকে হয়ে যায়। ভোটাররা বিমুখ হয়েছিলেন নির্বাচন থেকে। কম ছিল ভোটের হার। গাজীপুর নগরীর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাশিমপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে উৎসবের পুরোনো সেই চিত্র দেখা গেল। কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের ভিড়ে বিদ্যালয়ের ফটকের বাইরে মাঠে ছিল হাজারো মানুষের জটলা। কাউন্সিলর প্রার্থীদের পাঠানো রিকশায় বাড়ি বাড়ি থেকে আসছিলেন ভোটাররা। মাঠে বাহারি খাবারের দোকান নিয়ে বসেন হকাররা।

ভিড় ঢেলে শুধু প্রকৃত ভোটার কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারেন। প্রবেশপথে পুলিশের তল্লাশি। ভোট কেনাবেচা বন্ধে ভোট কক্ষে মোবাইল ফোন নিয়ে প্রবেশে ছিল কড়াকড়ি। কাশিমপুর বিদ্যালয়ে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল সাতটি। নারী ভোটার কেন্দ্রে ছিল উপচে পড়া ভিড়। সরু বারান্দায় গরম সয়ে কয়েকশ নারী অপেক্ষা করছিলেন ভোট দেওয়ার জন্য। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার এ এ এম মোহাম্মদ মোস্তাকিম বললেন, নারীরা দলে দলে আসছেন। দুই নম্বর বুথে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩২৮ ভোটারের ৭১ জন ভোট দিয়েছেন। বুথের বাইরে তখনও লাইনে শতাধিক নারী।
ভোটারের ঢল ছিল ৩ নম্বর ওয়ার্ডের হাতিমারা বিদ্যালয়ে নারী ভোটকেন্দ্র। ২০ নম্বর ভোটকেন্দ্রের ২ নম্বর বুথের বাইরে ৫ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেন এনায়েতপুরের বাসিন্দা নাসিমা বেগম। তিনি জানান, সকাল ৮টায় এসে দুপুর সোয়া ১টার দিকে ভোট দিয়েছেন। দীর্ঘ অপেক্ষায় ভুগতে হলেও খুশি নিজের ভোট বিনাবাধায় পছন্দের প্রার্থীকে দিতে পেরে।