পল্লী বিদ্যুতের সিস্টেম লস কমাতে গিয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা। অঙ্গহানি হচ্ছে কারও কারও। আবার কেউ হারাচ্ছেন জীবনটাই। হাইভোল্টেজ সঞ্চালন লাইনগুলোতে রাবারের কোটিং (আবরণ) না থাকায় ঘটছে এমন দুর্ঘটনা। অথচ বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না বলে অভিযোগ কিশোরগঞ্জের মানুষের।

পল্লী বিদ্যুতের প্রকৌশলী মো. জুলফিকারের দাবি, সঞ্চালন লাইনে রাবার কোটিং দিলে বিদ্যুতের সিস্টেম লস হয়। এই কারণে কিছু লোভোল্টেজ লাইনে রাবারে আবৃত তার দেওয়া হলেও হাইভোল্টেজ লাইনে রাবারে আবৃত তার দিতে চায় না সরকার।

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার যশোদল এলাকায় খেলার মাঠে প্রায় ১০ বছর আগে ঝুলে থাকা পল্লী বিদ্যুতের খোলা তারে জড়িয়ে আহত হয় চার শিশু। তাদের মধ্যে দিনমজুর মফিজ উদ্দিনের ছেলে আব্দুস সামাদ (১৯) দুটি কাটা হাত নিয়ে ভিক্ষা করেন।

গত ২০ মে কালেক্টরেট এলাকায় দেখা যায় সামাদকে। তখন সমকালকে জানান, তাঁর বড় বোন তানিয়ার বয়স এখন ২৪ বছর। ওই দুর্ঘটনার পর তাঁর পিঠের অনেকটা মাংস কেটে বাদ দিতে হয়। এখনও তাঁর বিয়ে হয়নি। তাঁর ফুফাতো বোন মাহফিলের বয়স ২০ বছর। একই দুর্ঘটনায় তাঁর পায়ের আঙুলগুলো কেটে ফেলতে হয়েছে। তাঁরও বিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সামাদের প্রতিবেশী সিরাজ মিয়ার মেয়ে বুড়ির বয়স ২২ বছর। ওই দুর্ঘটনায় তাঁর দুই হাতের আঙুল কেটে ফেলতে হয়েছে। এসব পরিবারকে তখন চিকিৎসা সহায়তা বাবদ কিছু টাকা দেয় পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। তবে কত টাকা দিয়েছিল তা জানা নেই সামাদের।

২০১৪ সালের ২৫ মে অষ্টগ্রামের দেওঘর এলাকার কৃষক এনায়েত মোল্লা (৪২) ঘরের চালে উঠতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পর্শে মারা যান। পরের বছর ২৭ আগস্ট সদর উপজেলার সেহড়া গ্রামে গাছ থেকে আমড়া পারতে গিয়েছিলেন লিটন নামে এক যুবক। গাছের ডালে খোলা সঞ্চালন লাইন স্পর্শ করে থাকায় বিদ্যুৎস্পর্শে মারা যান লিটন (২৫)।

২০১৬ সালের ২৬ জুলাই ইটনার এলংজুড়ি এলাকার হাওরে ঝুলে থাকা পল্লী বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে মারা যান ট্রলারচালক আফাজ উদ্দিন (৩০), যাত্রী আব্দুর রহিম (৫০), ফুল মিয়া (৪০) ও সজীব মিয়া (২৮)। এতে আহত হন সাত যাত্রী। পরের বছর ১১ জুলাই করিমগঞ্জের মরিচখালী বাজারে একটি ভবনের ছাদে উঠতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পর্শে প্রাণ যায় রাজন (১৭) নামে একজন মুচির।

২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলার বৌলাই পূর্ব ভরাটি গ্রামে ডিশ লাইনে কাজ করতে গিয়ে খোলা তারে জড়িয়ে প্রাণ যায় রাসেল বাবুর্চি (২৮) ও তাঁর চাচি নাজমা আক্তারের (৪৯)। একই বছর ১০ আগস্ট বাজিতপুরের বলিয়ারদি এলাকায় পুকুরে নেমে বিদ্যুৎস্পর্শে প্রাণ যায় সায়েম (১৫) ও নাঈম (১৩) নামে দুই কিশোরের। কারণ, পুকুরের পানিতে পড়ে ছিল পল্লী বিদ্যুতের খোলা তার।

২০২২ সালের ১৫ আগস্ট ইটনা সদরে জাতীয় পতাকা টানাতে গিয়ে বিজয় কর্মকার (১৫) ও হৃদয় কর্মকার (২০) নামে দুই সহোদরের মৃত্যু হয় বলে জানান উপজেলা চেয়ারম্যান চৌধুরী কামরুল হাসান। একই বছরের ২২ জানুয়ারি হোসেনপুরের গোবিন্দপুরে একটি ভবনে কাজ করতে গিয়ে ছাদের ওপর দিয়ে যাওয়া পল্লী বিদ্যুতের খোলা তারে জড়িয়ে দুটি হাত কাটা যায় নির্মাণ শ্রমিক রিটন মিয়ার। ভবন মালিক আজিজুল হকের কাছ থেকে তখনকার ইউএনও রাবেয়া পারভেজ সাড়ে ৪ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেন বলে জানান রিটন মিয়া। একই বছরের ১৭ আগস্ট ওই ভবনের ছাদে উঠে বিদ্যুৎস্পর্শে বাঁ হাতের চারটি আঙুল হারান দিনমজুর শফিকুল ইসলামের মেয়ে হাফিজার (৮)। তার পায়ের আঙুলগুলো কুঁচকে গেছে। তার পরিবারকেও ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেওয়া হয় বলে দাবি শফিকুলের।
চলতি বছরের ৯ মে চরকাটিহারী গ্রামে আনসারুল ইসলাম (৩২) গাছের কাঁঠাল পাড়তে গিয়ে বিদ্যুৎস্পর্শে মারা গেছেন। এই তথ্য জানান হোসেনপুরের জিনারি ইউপি চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলাম। এমন দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটছে পল্লী বিদ্যুতের খোলা তারে।

কথা হয় পল্লী বিদ্যুৎ গ্রাহকদের সংগঠন কিশোরগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সভাপতি তারেক কামালের সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, খোলা তারের কারণে মাঝেমধ্যেই ঘটছে দুর্ঘটনা। তবে তাঁর কাছে বছরওয়ারি হতাহতের কোনো পরিসংখ্যান নেই। তিনিও মনে করেন, আবরণযুক্ত তার দিলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।

কিশোরগঞ্জে পল্লী বিদ্যুতের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. জুলফিকারের ভাষ্য, তাঁর দপ্তরের অধীনে পল্লী বিদ্যুতের ১৪ হাজার কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন রয়েছে। এর মধ্যে ৩৩ হাজার, ১১ হাজার এবং ৬ হাজার ৩৫০ ভোল্টেজের লাইনগুলোতে খোলা তার। উন্মুক্ত তারের কারণে সামান্য দমকা বাতাসেও সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে হয়। তাঁর দাবি, রাবারের আবরণযুক্ত তার সরবরাহের জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবটি গৃহীত হলে এ ধরনের দুর্ঘটনার ভয় কেটে যাবে।