- সারাদেশ
- লিটনের আয় দেড় দশকে বেড়েছে ১২২ গুণ
রাজশাহী সিটি নির্বাচন
লিটনের আয় দেড় দশকে বেড়েছে ১২২ গুণ
স্বামী-স্ত্রী মিলে বছরে আয় ৬ কোটি ৮ লাখ ১০ হাজার টাকা

রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের গত দেড় দশকে আয় বেড়েছে প্রায় ১২২ গুণ। ২০০৮ সালে প্রথমবার মেয়র পদে নির্বাচনের সময় তাঁর বার্ষিক আয় ছিল মাত্র ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। এবার তাঁর বার্ষিক আয় দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৯৮ লাখ ১০ হাজার টাকা। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে শুধু লিটনের একার আয়ই বেড়েছে ৪ গুণের কাছাকাছি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে হলফনামায় আওয়ামী লীগের এই সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যের বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছিল ৭৮ লাখ টাকা। অন্যদিকে, ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কোনো নির্বাচনী হলফনামাতেই দুই মেয়াদে মেয়রের দায়িত্ব পালনকারী লিটনের স্ত্রীর কোনো আয় দেখানো হয়নি। তবে এবারের হলফনামায় স্ত্রী নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শাহিন আকতার রেনির বার্ষিক আয় তাঁর স্বামীকেও ছাড়িয়ে গেছে। বছরে লিটনের স্ত্রীর আয় দেখানো হয়েছে ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা। অর্থাৎ, স্বামী-স্ত্রী দু’জনের বার্ষিক আয় দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি ৮ লাখ ১০ হাজার টাকা।
হলফনামায় আয়ের খাতের বিবরণে উল্লেখ করা হয়েছে, মাছ চাষ থেকে সর্বোচ্চ ২ কোটি ৪২ লাখ টাকা বছরে আয় আসে লিটনের।
এই খাতে তাঁর স্ত্রীর আয় ১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। অন্য ব্যবসা থেকে তাঁর স্ত্রীর আয় আসে ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। গেল নির্বাচনের হলফনামায় মাছ চাষ থেকে লিটনের আয় দেখানো হয়েছিল ২০ লাখ টাকা আর ব্যবসা থেকে ১২ লাখ টাকা। সে সময় লিটনের স্ত্রীর কোনো আয় ছিল না।
পরপর দুই নির্বাচনের হলফনামা বিশ্লেষণ করলে মাছ চাষে লিটন পরিবারের আয়ের বড় ধরনের উত্থান ঘটেছে। আয়ের পরিমাণ লাফিয়ে বেড়েছে বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট কিংবা দোকান ভাড়ার ক্ষেত্রেও। ২০১৮ সালের নির্বাচনী হলফনামা অনুসারে, এই খাত থেকে লিটনের আয় ছিল ৫ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকা। এবার এই খাতে তাঁর আয় দাঁড়িয়েছে ৩৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
এবার কৃষি খাত থেকে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং মেয়রের সম্মানী ভাতা থেকে ১৬ লাখ ১০ হাজার টাকা আয় দেখিয়েছেন সদ্য সাবেক এই মেয়র।
হলফনামা অনুযায়ী, খায়রুজ্জামান লিটন ও তাঁর স্ত্রীর সম্পদের পরিমাণও বেড়েছে লক্ষণীয়ভাবে। ২০১৮ সালে লিটনের অস্থাবর সম্পত্তির মূল্যমান ছিল ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এবার তা বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ১৭ লাখ ৬২ হাজার ৮৯৯ টাকা। তাঁর স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯২ লাখ ৩ হাজার টাকা। এবার তা বেড়ে হয়েছে ২ কোটি ২০ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ২০১৮ সালে লিটনের কৃষিজমি ছিল ১ দশমিক ৬৩ একর। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৬৩ একরে।
স্ত্রী রেনির নামে আগে কোনো কৃষিজমি না থাকলেও এবার তাঁর নামে ১ দশমিক ৭৭ একর জমি দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া স্ত্রীর নামে উপশহরে জমিসহ একটি দোতলা পুরোনো বাড়ি ও ৭৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকার একটি মৎস্য খামার দেখানো হয়েছে। হলফনামায় আগে না থাকলেও এবার ৭০ লাখ ১২ হাজার ১৯০ টাকা মূল্যের একটি মৎস্য খামার লিটনের মালিকানায় দেখানো হয়েছে। আগেরবার না থাকলেও এবার পূবালী ব্যাংকে ২০ লাখ ৭৯ হাজার টাকার একটি গাড়ি কেনার ঋণ দেখিয়েছেন লিটন। পেশার ঘরে আইনজীবী বলে উল্লেখ করলেও পেশা থেকে এক পয়সাও আয় দেখাননি তিনি।
পাঁচ বছরে বার্ষিক আয়ের তুলনা
২০১৮ সালের হলফনামায় আয়ের উৎসের বিবরণে দেখা গেছে, কৃষি খাতে ছিল ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে ৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা, মৎস্য ব্যবসা থেকে ২০ লাখ এবং অন্য খাতে ১২ লাখ টাকা, শেয়ার ও সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ লাখ ১০ হাজার টাকাসহ অন্য খাত থেকে আয় ছিল ১৯ লাখ ৯ হাজার ৭০৮ টাকা।
এ ছাড়া অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নিজ নামে ছিল ৩০ হাজার টাকা, স্ত্রী নামে ২০ হাজার টাকা, ব্যাংকে জমা ছিল নিজের ১ কোটি ৩৮ লাখ ৫৩ হাজার ৪০৮ টাকা, স্ত্রীর নামে ৫৭ লাখ ৩৩ হাজার টাকা ও নির্ভরশীলদের নামে ২৩ লাখ ২৯ হাজার টাকা। এ ছাড়া স্থায়ী আমানতে নিজের নামে কিছু জমা না থাকলেও স্ত্রী নামে ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার এবং নির্ভরশীলদের নামে ২০ লাখ টাকা। জিপ গাড়ি বাবদ লিটনের ছিল ৩৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা। তিনি উপহার হিসেবে অলংকার পেয়েছিলেন ৫৩ হাজার ৮৬২ টাকার, স্ত্রীর ছিল ৫০ ভরি স্বর্ণালংকার। এ ছাড়া উপহার হিসেবে মেয়ের স্বর্ণালংকার ছিল ২১৬ ভরি। স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে ছিল নিজের ১.৬৩ একর কৃষিজমি। উপশহর হাউজিং এস্টেটে তিনতলা আবাসিক বাড়ি, ঢাকার বনানীতে ৫ কাঠার বিনিময়ে ২.৫টি অ্যাপার্টমেন্ট।
লিটনের ধারেকাছেও কেউ নেই
রাসিক নির্বাচনে এবার মেয়র পদে লড়ছেন চারজন। আয় ও সম্পদের পরিমাণ বিবেচনায় খায়রুজ্জামান লিটনের ধারেকাছে বাকি তিন প্রার্থীর কেউ নেই। লিটনের বার্ষিক আয় যখন কোটি ছাড়িয়ে, তখন বাকিদের ৩ লাখের আশপাশে।
নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা থেকে জানা যায়, ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুরশিদ আলমের বার্ষিক আয় ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা, যা তিনি টিউশনি ও ধর্মীয় আলোচনা থেকে উপার্জন করেন। অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে নগদ ১২ লাখ টাকা রয়েছে তাঁর। স্থাবর সম্পত্তি নেই কিছুই। জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাইফুল ইসলাম স্বপন তাঁর ব্যবসা থেকে বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ৩ লাখ টাকা। অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে নগদ ৩ লাখ ও ব্যাংকে ৫০ হাজার টাকা দেখিয়েছেন তিনি। তাঁর সাড়ে ৪ বিঘা কৃষিজমি ও ১২ শতক অকৃষি জমি রয়েছে। জাকের পার্টির প্রার্থী লতিফ আনোয়ার আইন ব্যবসা থেকে বছরে আয় করেন ৩ লাখ টাকা। ১ লাখ টাকা নগদ আর ব্যাংকে রয়েছে ২ হাজার টাকা। স্থাবর কোনো সম্পত্তি তাঁর হলফনামায় নেই।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহীর সভাপতি আহমেদ শফিউদ্দিন বলেন, হলফনামা থেকে প্রার্থীর জীবনাচরণ ও আর্থিক পরিস্থিতির একটি তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যায়। সে কারণে ভোটারদের সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়। আমার মনে হয়, হলফনামায় দেওয়া তথ্য যাচাই করার ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা থাকা জরুরি।
রাসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন জানান, নিয়ম অনুসারে তাঁরা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রার্থীদের দেওয়া হলফনামা নিয়েছেন। বিধি অনুসারে তথ্যগুলো ভোটারদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। তবে তথ্য যাচাইয়ের কোনো সুযোগ তাঁদের নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এগুলো আয়কর বিভাগের কাজ। যদি কোথাও কোনো অসংগতি থাকে, তাহলে তারা দেখবে সেটা।
এ ব্যাপারে জানতে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের মোবাইলে ফোন দেওয়া হলে তিনি ধরেননি। নিজের পরিচয় দিয়ে সংবাদের ব্যাপারে কথা বলতে চাই– এমন এসএমএস পাঠানোর পরও তিনি সাড়া দেননি।
মন্তব্য করুন