গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিজস্ব ভোটের পুরোটা পায়নি নৌকা। কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগ নেতারা যেসব কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন, তার অনেকগুলোতে বড় ব্যবধানে হেরেছেন দলটির মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খান। অন্যদিকে, তাক লাগিয়ে মেয়র পদে জয় পাওয়া দলটির বহিষ্কৃত নেতা জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন আওয়ামী লীগ বিরোধী সব ভোট পেয়েছেন। কাউন্সিলর পদে যেসব ওয়ার্ডে বিএনপি নেতারা জিতেছেন, সেখানে জায়েদার টেবিল ঘড়িও একচেটিয়া জয় পেয়েছে। আওয়ামী লীগের একাংশের ভোটও গেছে জাহাঙ্গীরের মায়ের ঘরে।

গাজীপুর নির্বাচনের বিস্তারিত ফল বিশ্লেষণে এই তথ্য দেখা যাচ্ছে। গাজীপুরের গাছা থানায় কখনও নৌকা হারেনি। কিন্তু এবার গাছার সাতটি ওয়ার্ডের সব ক’টি কেন্দ্রে হেরেছে নৌকা। ঘড়ির চেয়ে প্রায় ১৩ হাজার ৫০৯ ভোট কম পেয়েছে। অথচ এই সাতটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ নেতারা কাউন্সিলর পদে জয়ী হয়েছেন। নিজ এলাকা টঙ্গীতে আজমত উল্লা জিতলেও একচেটিয়া ভোট পাননি। তাঁর ৭৩ হাজার ৭৮৪ ভোটের বিপরীতে ঘড়ি পেয়েছে ৫৫ হাজার ২৯২ ভোট।

তবে জাহাঙ্গীর তাঁর নিজ এলাকা জয়দেবপুরে একচেটিয়া জয় পেয়েছেন। এই এলাকার ৩৫টি ওয়ার্ডের ১১টি ওয়ার্ডে বিএনপি নেতারা কাউন্সিলর পদে জয় পেয়েছেন। এসব ওয়ার্ডের কেন্দ্রগুলোতে নৌকা পাত্তাই পায়নি ঘড়ির বিপক্ষে।

পরাজয়ের ১০ কারণ

পরাজয়ের ১০টি কারণ চিহ্নিত করেছে সরকারি সংস্থা। আওয়ামী লীগ এবং সরকারি সংস্থাগুলোর বিশ্লেষণেও এসেছে এই তথ্য। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ের বিষয়ে অতি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থিতা বাতিল হলে তাঁর গৃহিণী মা জায়েদা খাতুনকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ধর্তব্যের মধ্যে নেননি।

একটি সংস্থার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের ধারণা ছিল, ২৫-৩০ শতাংশ ভোট পড়বে। কিন্তু নির্বিঘ্নে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়া যাচ্ছে খবরে বেলা বাড়ার সঙ্গে ভোটার উপস্থিতি বাড়তে থাকে। আওয়ামী লীগ সমর্থক নন এমন ভোটাররাও কেন্দ্রে আসেন। তাঁদের ভোট ঘড়িতে যাওয়ায় নৌকার হার নিশ্চিত হয়। বস্তিবাসী এবং নারীদের একচেটিয়ে ভোট পেয়েছে ঘড়ি। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকদের ভোট পেয়েছে টেবিল ঘড়ি।

সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, জাহাঙ্গীরের তুলনায় নির্বাচনের প্রচার নৌকার প্রার্থী তেমন একটা টাকা খরচ করেননি। আওয়ামী লীগের একাংশ গোপনে ঘড়ির পক্ষে কেন্দ্রে কাজ করেছে। নৌকার প্রার্থী তা ধরতে পারেননি। তাঁর এজেন্টরা কেন্দ্রের ভেতরেও নৌকার পক্ষে তৎপর ছিলেন না। ভোটের পর আজমত উল্লা বলেছেন, দলে থাকা বেইমানদের গাদ্দারিতে হেরেছেন।

আবার সাধারণ মানুষের সঙ্গে আজমত উল্লার যোগাযোগ জাহাঙ্গীরের মতো নিবিড় নয়। গাজীপুর-টঙ্গীর ভোটারদের একটি বড় অংশ শ্রমিক। তারা জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে নানা সময়ে সাহায্য-সুবিধা পেয়েছেন।

মেয়র থাকাকালে এলাকার রাস্তার উন্নয়ন করেছেন জাহাঙ্গীর। এর সুফল পেয়েছেন ভোটে।

গাছার ভোটে নৌকার বড় পরাজয়

গত বৃহস্পিতবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে টেবিল ঘড়ির কাছে নৌকা হেরেছে ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটে। আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত গাছায় জিতলে পরাজয় ঠেকাতে পারত নৌকা। গাছার সাতটি ওয়ার্ডে নৌকা পেয়েছে ১৫ হাজার ৭৩৯ ভোট। ঘড়ি পেয়েছে ২৯ হাজার ২৪৮ ভোট।
গাজীপুরের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে নৌকা পেয়েছে ১ হাজার ৪৯৮ ভোট। ঘড়ি পেয়েছে ৪ হাজার ৪৪২ ভোট, যা নৌকার প্রায় দ্বিগুণ। এই ওয়ার্ডে টিফিন ক্যারিয়ার প্রতীকে কাউন্সিলর হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি পেয়েছেন ২ হাজার ৩৮০ ভোট। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকা কাউন্সিলর প্রার্থীও আওয়ামী লীগ নেতা। তাঁরা জাহাঙ্গীরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। নিজেদের জন্য ভোটার কেন্দ্রে আনলেও, তাই ভোট নৌকা না এসে গিয়েছে ঘড়িতে।

৩২, ৩৩ এবং ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে নৌকার দ্বিগুণ ভোট পেয়েছে ঘড়ি। ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল হোসেন মোল্লা ৫ হাজার ৮৬৬ ভোট পেয়ে। তিনি ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। অথচ এই ওয়ার্ডে নৌকা পেয়েছে মাত্র ২ হাজার ৩৪০ ভোট। টেবিল ঘড়ি পেয়েছে ৫ হাজার ৫১১ ভোট, যা জয়ী কাউন্সিলরের ভোটের প্রায় কাছাকাছি।

৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুল্লাহ আল মামুন (মামুন মণ্ডল) মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও পরে দলীয় সিদ্ধান্তে সরে যান। গাছায় নৌকার শোচনীয় পরাজয়ের জন্য মামুন দায়ী করেছেন থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে।

তিনি বলেন, গাছা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক আদম আলী দু’জনেই জাহাঙ্গীরের চিহ্নিত অনুসারী। অথচ আওয়ামী লীগ তাঁদেরই ভোটকেন্দ্রের দায়িত্ব দিয়েছে। তাঁরা যাঁদের নৌকার এজেন্ট হিসেবে কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন, তাঁরা জাহাঙ্গীরের হয়ে কাজ করেছেন।

এই অভিযোগকে পুরোপুরি অসত্য আখ্যা দিয়ে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করছি। এ মুহূর্তে মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত। কোত্থকে যে কি হয়ে গেল, বুঝতে পারছি না।

গাছা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আদম আলী নৌকার পরাজয়ের কাউন্সিলর প্রার্থীদের দায়ী করছেন। তিনি বলেন, গাছায় কখনও নৌকা হারেনি। কাউন্সিলর প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতারা নৌকার বিপক্ষে কাজ করেছেন। নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী টাকা খরচ করেননি বলে অভিযোগ আদম আলীর। তিনি বলেন, নৌকা প্রার্থী ভোটের প্রচারের প্রথম দিকে দিনে মাত্র ৩ হাজার করে টাকা দিয়েছেন। ভোটের আগের রাতে কেন্দ্রপ্রতি ২৫ হাজার করে টাকা খরচ দিয়েছে। এই টাকায় ভোট কেনা যায় না। বিপরীতে জাহাঙ্গীর জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে, এমন সব কাউন্সিলর প্রার্থীকে নির্বাচনের খরচ দিয়েছেন।

টঙ্গীর ভোটেও ভাগ বসিয়েছেন জাহাঙ্গীর

নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা ১৮ বছর টঙ্গী পৌরসভার মেয়র ছিলেন। এখানে তিনি একচেটিয়া ভোট পাবেন বলে ধারণা করা হয়েছিল, কিন্তু তা হয়নি। ভোটের আগে প্রচার চালাতে গিয়ে একাধিকবার বাধা ও হামলার মুখে পড়েছিলেন জাহাঙ্গীরের মা।

ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেল, টঙ্গীর ১৬৩টি কেন্দ্রে নৌকা পেয়েছে ৭৩ হাজার ৭৮৪ ভোট। এখানে জায়েদা খাতুন পেয়েছেন ৫৫ হাজার ২৯২ ভোট। টঙ্গীতে ভোটের ৪৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। অথচ গাজীপুরে ভোটের হার ৪৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সেই তুলনায় টঙ্গী ভোট পড়েছে কম। টঙ্গীতে মোট ভোটের হিসাবে আজমত এগিয়ে থাকলে নারী ভোটকেন্দ্রে এবং শ্রমজীবী মানুষের এলাকায় হেরেছেন।

টঙ্গীর এরশাদনগরে রওশন এরশাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে মোট নারী ভোটার ছিলেন ১ হাজার ৪২৫টি। ওই কেন্দ্রে ৫৪ শতাংশ ভোট পড়েছে। আজমত উল্লাহ পেয়েছেন ৩০৯ আর জায়েদা খাতুন ৩২৬ ভোট। টঙ্গীর ‘সরকার’ পরিবারের সদস্য সরকার শাহনূর ইসলাম রনি পেয়েছেন মাত্র ৫৫ ভোট।

টঙ্গী পৌরসভার মেয়র থাকাকালে আজমত উল্লা যে উন্নয়ন করতে পারেননি, জাহাঙ্গীর তা করেছেন। টঙ্গীর বিভিন্ন সড়ক প্রশস্ত করতে মানুষের বাড়িঘর ভেঙে তিনি সমালোচিত হলেও যেখানে রাস্তা নির্মাণ করেছেন, সেখানেই বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছে ঘড়ি। বনমালা এলাকার সড়ক প্রশস্ত করেছিলেন জাহাঙ্গীর। আজমত উল্লার টঙ্গীর এই এলাকার ১৬টি কেন্দ্রে সবক’টিতে জিতেছে ঘড়ি। বনমালা এলাকার মাদারল্যান্ড স্কুল কেন্দ্রে নৌকা পেয়েছে মাত্র ১৯৫ ভোট। জাহাঙ্গীরের মা পেয়েছেন ৬৪৫ ভোট।

শ্রমজীবী মানুষের এলাকা এরশাদনগরের ১০টি কেন্দ্রের ৮টিতে হেরেছে নৌকা। এ ছাড়া এরশাদনগরে মজিদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের এক নম্বর কেন্দ্রেও আজমত হেরেছেন। ওই কেন্দ্রে নৌকা পেয়েছে ৩৩০ ভোট আর টেবিল ঘড়ি পায় ৪৫১ ভোট। এ ছাড়া মজিদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২ নম্বর কেন্দ্রেও চমক দেখান জায়েদা। সেই কেন্দ্রে আজমত পেয়েছেন মাত্র ২৮৬ ভোট। আর জায়েদা পেয়েছেন ৪০৪ ভোট।

মন্ত্রীর এলাকায় নৌকার বড় জয়েও শেষ রক্ষা হলো না

সিটি করপোরেশনের ১ থেকে ১৮ নম্বর ওয়ার্ড গাজীপুর-১ আসনের অন্তর্ভুক্ত। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ  ক ম মোজাম্মেল হক এই আসনের এমপি। ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত ফয়সাল সরকার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাউন্সিলর হয়েছেন। বাকি ১৭টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ নেতারা কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। সেখানে বিএনপির কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। ফলে দলটির কর্মী-সমর্থকদের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ ছিল না। বিএনপি সমর্থকরা কেন্দ্রে না যাওয়ায় এই ১৭টি ওয়ার্ডের বেশিরভাগ কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন আজমত উল্লা।
গাজীপুরের ৪৮০টি ভোটকেন্দ্রের ১ থেকে ২৫ নম্বর কেন্দ্রে টানা জয় পেয়েছে নৌকা। কিন্তু যেখানে বিএনপির প্রার্থী ছিল, সেখানে ফল নৌকার অনুকূলে আসেনি। ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কেন্দ্রগুলোতে বড় ব্যবধানে হেরেছে নৌকা। চান্দনা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের তিনটি কেন্দ্রেই বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছে ঘড়ি। চান্দনার ২ নম্বর কেন্দ্রে ঘড়ির ৮৩৪ ভোটের বিপরীতে ৩৫২ ভোট পেয়েছে নৌকা।

১৩ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খোরসেদ আলম সরকার। তিনি স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী সরকারের পরিবারের সদস্য। আজমত উল্লার পক্ষে নয়, কাউন্সিলর প্রার্থীর নির্বাচনে জোর ছিল সরকার পরিবারে। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইটাহাটার তিনটি কেন্দ্রেই বড় ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন জাহাঙ্গীর আলমের মা। ইটাহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কেন্দ্রের ৩ নম্বর কেন্দ্রে  টেবিল ঘড়ি পেয়েছে ১ হাজার ১১০ ভোট। নৌকা পেয়েছে ৫৪৩ ভোট।

ঘড়িকে এগিয়ে দিয়েছেন নারীরা

নারী ভোটকেন্দ্রের অধিকাংশে জয়ী হয়েছেন জাহাঙ্গীরের মা। গাজীপুর সিটির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের হাতিমারা স্কুল অ্যান্ড কলেজে পুরুষ কেন্দ্রে নৌকা পেয়েছে ১ হাজার ৪০ ভোট। ঘড়ি পেয়েছে ১ হাজার ৩ ভোট। কিন্তু নারীরা যে দুই কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন, তাতে জয়ী হয়েছেন জায়েদা খাতুন। হাতিমারা স্কুলে ২ নম্বর কেন্দ্রে নৌকা পেয়েছে ৫৩২ ভোট, ঘড়ি পেয়েছে ৭৩২ ভোট। গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় প্রায় সব পুরুষ ভোটকেন্দ্রে নৌকা জিতলেও, মহিলা ভোটকেন্দ্রে একচেটিয়া জয় পেয়েছেন গাজীপুরের প্রথম নারী মেয়র জায়েদা খাতুন।