
প্রতীকী ছবি
ইছামতী, খোলপেটুয়া, সাপমারা ও লাবণ্যবতী নদী-খাল ঘিরে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার মানুষের জীবনজীবিকা। এ অঞ্চলের মানুষের আয়ের প্রধান উৎস মাছ চাষ। ২০ ভাগ মানুষের নিজস্ব ঘের থাকলেও বাকি ৮০ ভাগই শ্রমজীবী। কিছু জায়গায় ধান চাষ হয়, কিন্তু বৃষ্টির অভাবে চলতি বছর চাষিদের তেমন লাভ হচ্ছে না। যে অঞ্চলে মানুষ মাছ বিক্রি করে ধান কেনে, সেই অঞ্চলে এবার মাছ চাষেও আশানুরূপ লাভ হয়নি। ফলে অভাবকে নিত্যসঙ্গী করে দিন কাটছে দেবহাটার মানুষের। বাল্যবিয়ে, শারীরিক ঝুঁকি, অনিরাপদ মাতৃত্বসহ নানাভাবে এই অভাবের বলি হচ্ছে মেয়ে শিশুরা। কথাগুলো বলছিলেন দেবহাটার স্থানীয় সাংবাদিক রেজাউল করিম বাপ্পা।
সেভ দ্য চিলড্রেনের রাইট টু গ্রো প্রোজেক্টের ব্যবস্থাপক তাওফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দেবহাটা অঞ্চলে ৮০ শতাংশের বেশি মেয়ে শিশু বাল্যবিয়ের শিকার। এক গ্রামে শিশুসন্তানসহ ১৫ জন মাকে ডাকা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ১২ জন মায়ের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে। মূলত দরিদ্রতার কারণে এ অঞ্চলের অধিকাংশ বাবা-মা তাঁদের মেয়ে সন্তানকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেন। কৈশরে গর্ভধারণ এবং ঘরে অদক্ষ দাইয়ের হাতে সন্তান প্রসবের সংখ্যাও বেশি এ অঞ্চলে। ফলে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস পেলেও এ অঞ্চলে তা বিদ্যামান।’
গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেবহাটার ২ নম্বর পারুলিয়া ইউনিয়নের সুবর্ণবাদ গ্রাম, ৩ নম্বর সখীপুর ইউনিয়নের কোওড়া ও আশকারপুর গ্রাম এবং ৪ নম্বর নওয়াপাড়া ইউনিয়নের চিনেডাঙ্গা গ্রামে গিয়ে তাওফিকুল ইসলামের কথার প্রমাণ মেলে। এসব গ্রামে কিশোরীদের পিরিয়ড শুরুর পর ১০-১১ বছর বয়সেই বিয়ে দেওয়া হয়। দেবহাটা ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হওয়ায় এখানকার মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। এ অবস্থায় মেয়ে ঘরে বসিয়ে রাখা সবাই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। তরুণরা মাদকসেবী হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে মেয়েরা আরও ঝুঁকির সম্মুখীন।’
৫ নম্বর ওয়ার্ডের চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন বকুল বলেন, ‘নানা কুসংস্কারের প্রচলন থাকায় এখানে মেয়েদের শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি বেশি। সবাই চিন্তা করে মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখলে, যে কোনো সময় কিছু ঘটে যেতে পারে। তখন আর বিয়ে দিতে পারবে না।’
বাল্যকালে গর্ভধারণ, অপুষ্টিতে ভুগছে অধিকাংশ মা ও শিশু
পুষ্টিহীনতায় ভোগা ১৩ মাসের সন্তানকে নিয়ে দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়েছেন মা সালমা বেগম। চিকিৎসক জানিয়েছেন, মায়ের পুষ্টিহীনতার কারণে গর্ভাবস্থা থেকেই শিশুটিও পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। ফলে জন্ম থেকে বাচ্চাটি নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য বলছে, প্রতি মাসে হাসপাতালে এমন অন্তত ৩ থেকে ৪ জন পুষ্টিহীনতার শিকার শিশু ভর্তি হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় চিকিৎসা নিতে আসাদের মধ্যে পুষ্টিহীনতায় ভোগা শিশুর সংখ্যা ৪০ শতাংশেরও বেশি। দারিদ্র্য ও মায়ের অসচেতনতার পাশাপাশি বাল্যবিয়েই এর প্রধান কারণ বলছেন পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা।
২০২১ সালে ইউনিসেফের এক জরিপে উঠে এসেছে, সাতক্ষীরা জেলায় মোট বিয়ের ৭৭.৭ শতাংশ হচ্ছে বাল্যবিয়ে। জেলা শিক্ষা অফিস বলছে, শুধু করোনাকালে এখানে বাল্যবিয়ে হয়েছে ৫৪০ জন স্কুলশিক্ষার্থীর। এ সময়ে স্কুলজীবন শেষ করেছে মাত্র ১২ শতাংশ কিশোরী। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আব্দুল লতিফ বলেন, ‘দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল হওয়ায় নানা সংকটে পড়তে হয় মানুষকে। দরিদ্রতার কারণে এ জেলায় যেমন বাল্যবিয়ে বেশি, তেমনি অপুষ্টির শিকার প্রচুর শিশু জন্ম নেয়। ফলে মায়ের পাশাপাশি শিশুরা বিভিন্ন জটিলতায় ভোগে।’
অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক সেহেরিন ফরহাদ সিদ্দিকা বলেন, ‘সাধারণত একটি মেয়ের শারীরিক বৃদ্ধি ১৮ বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এ সময়ে তাঁর শরীরে অনেক পুষ্টির প্রয়োজন। এর মধ্যে কোনো মেয়ে গর্ভধারণ করলে শিশুর জন্য যথাযথ পুষ্টি তার শরীর থেকে সরবরাহ হয় না। ফলে মা ও শিশু উভয়ে পুষ্টিহীন হয়। এ ছাড়া রক্ত স্বল্পতাজনিত কারণে কিশোরী মায়েরা রক্তচাপ, অসময়ে বাচ্চা প্রসবসহ বিভিন্ন জটিল সমস্যায় পড়েন।’
বাল্যবিয়ে রোধে কঠোর অবস্থান
উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নাসরিন জাহান বলেন, বাল্যবিয়ে রোধে ইউএনওর নির্দেশনায় নিয়মিত সভা ও তাদরকি করা হচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে ২০১৯ সালে ৯টি, ২০২০ সালে ৫টি, ২০২১ সালে ৭টি এবং ২০২২ সালে ২৬টি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা হয়েছে। সম্প্রতি বাল্যবিয়ে দেওয়ার অপরাধে নোওয়াপাড়া ইউনিয়নে আবুল বাশার নামে এক কাজিকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ছাড়া বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আইনে মামলা হয়েছে ওই কাজির বিরুদ্ধে।
দেবহাটার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধসহ শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার নিয়ে কাজ করছে সেভ দ্য চিলড্রেন, ওয়ার্ল্ডভিশনসহ স্থানীয় কয়েকটি এনজিও। পারুলিয়া ইউনিয়নের রাইট টু গ্রো প্রোজেক্টের সাবেক কর্মকর্তা অনিন্দিতা বিশ্বাস বলেন, ‘এ অঞ্চলে কাজিরা একাধিক রেজিস্টার বই রাখেন। ইউএনও নেতৃত্বে অনেক কাজিকে জরিমানা ও তাঁদের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। ওয়ার্ল্ডভিশনের এরিয়া প্রোগ্রাম বাল্যবিয়ে নিয়ে অনেক কাজ করছে। ফলে এখন অনেকে সচেতন হয়ে উঠছেন।’
এদিকে ‘গর্ভকালে চারবার সেবা গ্রহণ করি, নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করি’ স্লোগানে আজ রোববার দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। ১৯৯৭ সাল থেকে দেশে প্রতিবছর ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালন করে আসছে অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ।
মন্তব্য করুন