- সারাদেশ
- ঔষধের মূল্যে প্রাণ ওষ্ঠাগত
ঔষধের মূল্যে প্রাণ ওষ্ঠাগত
নিত্যপণ্যের সহিত দফায় দফায় গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তৈলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অধিকাংশ মানুষ বিশেষত সীমিত ও নিম্নআয়ভুক্ত পরিবারগুলি যখন জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহে হিমশিম খাইতেছে, তখনই আরেক দফা বৃদ্ধি পাইল জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন ঔষধের মূল্য। সোমবার সমকালের শীর্ষ প্রতিবেদনে যেমনটা বলা হইয়াছে, দেশের শীর্ষ ছয় প্রতিষ্ঠান তাহাদের উৎপাদিত ২৩৪টি ঔষধের মূল্য ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াইয়াছে এবং আরও ১০ কোম্পানি তাহাদের উৎপাদিত ঔষধের মূল্য বাড়াইতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আবেদন করিয়াছে। অর্থাৎ এই দফায় প্রায় সকল প্রকার ঔষধের মূল্য বৃদ্ধি পাইতে চলিয়াছে। স্মরণ করা যাইতে পারে, গত জুনে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বহুল ব্যবহৃত ২০টি ঔষধের মূল্য ১৩২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করার এক মাস পর অত্যাবশ্যকীয় ৫৩ প্রকার ঔষধের মূল্য বাড়াইয়াছিল সরকার। গত নভেম্বরে একটি কোম্পানির ২৪ প্রকার ঔষধের মূল্য প্রকারভেদে ৫ হইতে ১২ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। অধিকতর উদ্বেগজনক হইল, সরকার-নির্ধারিত মূল্যে কোনো ঔষধই বাজারে বিক্রয় হয় না। যেমন সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলিয়াছে, তাহারা ঔষধের মূল্য ১০ হইতে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করিয়াছে। বাস্তবে প্রথমেই যেমনটি বলা হইয়াছে, এই মূল্যবৃদ্ধি ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঘটিয়াছে। উপরন্তু খুচরা বিক্রেতা ঔষধালয়গুলি কোম্পানি নির্ধারিত মূল্যে ঔষধ বিক্রয় করিতেছে– এমনটা ভাবার সুযোগ কম। কারণ, কোনো পর্যায়েই বাজার তদারকির কাজটা অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই ঠিকঠাক হয় না। উল্লেখ্য, বিদ্যমান আইন অনুসারে অত্যাবশ্যকীয় বলিয়া তালিকাভুক্ত ১১৭টি ঔষধের মূল্য নির্ধারণ করিয়া দিবার দায়িত্ব হইল ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। অন্যান্য ঔষধের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলির প্রস্তাব অনুসারে অধিদপ্তর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে একজন মানুষের মোট চিকিৎসার ৬৪ শতাংশ ব্যয় হয় ঔষধ ক্রয়ে। ফলে দফায় দফায় এই জীবন রক্ষাকারী দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের কাটা ঘায়ে লবণ ছিটানোর মতো হইবে, সন্দেহ নাই। তবে অধিকতর চিন্তার বিষয় হইল, সমস্যা শুধু ইহাতেই সীমাবদ্ধ থাকিবে না। সংশ্লিষ্ট খাত বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ঔষধের মূল্যবৃদ্ধি একদিকে চিকিৎসা ব্যবস্থায় বড় সংকট সৃষ্টি করিতে পারে, অপরদিকে বাজার তদারকি না থাকায় নকল, ভেজাল আর নিম্নমানের ঔষধ বাজারে ছড়াইয়া পড়িবার শঙ্কাও আছে। যাহার পরিণাম বুঝিতে সংবাদমাধ্যমে প্রায়শ খবর হওয়া নকল-ভেজাল ঔষধ খাইয়া শিশুমৃত্যুর ঘটনা স্মরণ করাই যথেষ্ট। এইদিকে ঔষধের বাজার তদারকির দায়িত্ব ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের হইলেও উহারা তাহা কদাচিৎ পালন করে। এই জন্য সংস্থাটি কয়েক দশক ধরিয়া জনবল সংকটের অজুহাত প্রদর্শন করিলেও বাস্তবে অন্য প্রায় সকল সরকারি সংস্থার ন্যায় ইহাও জনস্বার্থের প্রতি এক ধরনের উদাসীনতা লালন করে। অনস্বীকার্য, সরকারি মহলে ঔষধ কোম্পানিসমূহের মালিকদের বেশ প্রভাব থাকায় তাহাদের সহিত ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পারিয়া ওঠা কঠিন। তবে এইরূপ অভিযোগও বিরল নহে– বহু কোম্পানির সহিত অধিদপ্তরের নীতিহীন কর্মকর্তাদের একপ্রকার আঁতাত রহিয়াছে।
বিদ্যমান বাজারের আগুনের আঁচ ঔষধ উৎপাদনেও লাগা স্বাভাবিক এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে ঔষধের মূল্যবৃদ্ধি ব্যতীত বিকল্প নাই বলিয়া উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের যুক্তিও অগ্রহণযোগ্য নহে। তবে আমাদের বক্তব্য, এই সকল যুক্তি ঔষধ কোম্পানিগুলির স্বেচ্ছাচারকে যৌক্তিকতা দেয় না।
আমরা মনে করি, অন্য সকল নিত্যপণ্যের ন্যায় ঔষধ খাতেও মূল্যবৃদ্ধির বিষয়একটা ঘোষিত নীতি ও সূত্র অনুসারে নির্ধারিত হইতে পারে, যথায় সকল অংশীজনের মতের ভিত্তিতে সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে। একই সঙ্গে মাঠ পর্যায়ে সিদ্ধান্তটির হুবহু বাস্তবায়ন তদারকিরও যথাযথ ব্যবস্থা থাকিতে হইবে। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার অবিলম্বে ঔষধের সাম্প্রতিক বর্ধিত মূল্য স্থগিত করিয়া গণমুখী একটা প্রক্রিয়া কার্যকর করার লক্ষ্যে সচেষ্ট হইবে।
মন্তব্য করুন