ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

কোনো বাধায় দমেনি খুদে মেয়েরা

অদম্য

কোনো বাধায় দমেনি খুদে মেয়েরা

বাঞ্ছারামপুরে ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলাম ফুটবল ক্লাবের মেয়েরা -সমকাল

আমজাদ হোসেন সজল বাঞ্ছারামপুর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৩ | ১৮:০০

ঘুম থেকে উঠতে হয় খুব ভোরে। এরপর ঝটপট প্রস্তুত হয়ে মাঠের উদ্দেশে দৌড়। যাদের বাড়ি মাঠের কাছাকাছি, তারা দৌড়ে বা হেঁটেই আসে। আর ১০-১৫ কিলোমিটার দূরে যাদের বাড়ি, তারা আসে সাইকেল চালিয়ে। এরপর খুদে মেয়েরা শুরু করে অনুশীলন। দিনের পর দিন এমন কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে তারা পেয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে দেশের সেরা ফুটবল দলের স্বীকৃতি। এবার বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপের চ্যাম্পিয়ন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই ছাত্রীরা।

গত ২১ মার্চ ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাতীয় পর্যায়ের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপ-২০২২-এর ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। এদিন মুখোমুখি হয়েছিল বাঞ্ছারামপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের নলমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২-১ গোলে চ্যাম্পিয়ন হয় বাঞ্ছারামপুরের মেয়েরা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত ফাইনাল শেষে পুরস্কার বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গোল্ডেন বুট পায় বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী নুরুন্নাহার আক্তার। চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার ফুটবল দলটির নেতা। তাকে নিয়ে দলের কোচ রফিকুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি গ্রহণ করেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে গোল্ডেন বুটের ট্রফি ও রেপ্লিকা চেক গ্রহণ করে সুমাইয়া।

শুধু সকালে ঘুম থেকে উঠে, মাঠে গিয়ে অনুশীলন করেই প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে দেশের সেরা ফুটবল দলের স্বীকৃতি মেলেনি বাঞ্ছারামপুরের এই মেয়েদের। তাদের যাত্রাপথ ছিল খুব কঠিন। অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। তাদের মধ্যে কারও বাবা দিনমজুর, কারও বাবা রিকশাচালক, কেউ কৃষিকাজ করেন। সেই সঙ্গে রয়েছে সামাজিক বাধা। আশপাশের মানুষদের নানা ধরনের কটু কথা। তবে তাদের অদম্য মেধা আর ইচ্ছাশক্তির কাছে কোনো বাধাই টেকেনি।

দলের অধিনায়ক সুমাইয়া আক্তারের বাবা রিকশাচালক আহসান উল্লাহ বলেন, আমার মেয়ে ফুটবল খেলে বলে অনেকেই খারাপ মন্তব্য করেছিল। যখন চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার নিয়েছে, তখন তারাই আমার মেয়ের প্রশংসা করেছে।

২০১১ সাল থেকে বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু হয়। তখন থেকে বাঞ্ছারামপুরের মেয়েরা এতে অংশ নেয়। এই টুর্নামেন্টে উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তাদের ভাগ্য বদলে যায়। এরপর জেলা পর্যায়ে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয়। তবে তারা দমে যায়নি। এই বিদায় থেকে আবারও স্বপ্ন বুনতে থাকে। উপজেলা থেকে জেলা ও জেলা থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করে সাফল্য অর্জন করে। এই বিদ্যালয়ের সাবেক তিন ছাত্রী অনূর্ধ্ব-১৫ মহিলা জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে খেলছে।

খুদে মেয়ে ফুটবলাররা যখন একের পর এক সাফল্য পেতে থাকে, তখন আর্থিক সংকটে তাদের প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এই সময় তাদের মেধা কাজে লাগাতে ২০১৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ (বাঞ্ছারামপুর) আসনের সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম নিজ নামে গঠন করেন ‘ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম ফুটবল ক্লাব’। এরপর মেয়েরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন বুনতে থাকে। উপজেলা থেকে প্রশিক্ষণ নিতে বাঞ্ছারামপুর এস এম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আসতে শুরু করে খুদে মেয়েরা। দূরের মেয়েদের প্রশিক্ষণে আসতে ক্লাবের পক্ষ থেকে বাইসাইকেল দেওয়া হয়। বর্তমানে ক্লাবের সদস্য ৫০ জন। তাদের জন্য রয়েছেন একাধিক প্রশিক্ষক। তাঁরা হলেন–সাবেক ফুটবলার তাইবুর হাসান (মাসুম), রফিকুল ইসলাম ও সুনীল দে।

কোচ রফিকুল ইসলাম বলেন, মেয়েরা ভালো ফুটবল খেললেও প্রথম দিকে অভিভাবকরা ক্লাবে পাঠাতে চাননি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে মেয়েদের আনতে হয়েছে। এখন আর তেমন সমস্যা নেই। সবার কাছ থেকে ভালো সাড়া মিলছে।
তাজুল ইসলাম ফুটবল ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক কাজী জাদিদ আল রহমান বলেন, শুরু থেকেই খুদে মেয়েদের সাফল্য সবাইকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ঈদের পর তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মীর রফিকুল ইসলাম জানান, তাজুল ইসলাম ফুটবল ক্লাব গঠন না করলে মেয়েদের এই সাফল্য হয়তো সম্ভব হতো না।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একি মিত্র চাকমা বলেন, তাদের খেলা দেখে আমি অভিভূত। এই মেয়েদের খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।

এবি তাজুল ইসলাম বলেন, বাঞ্ছারামপুরের ছোট্ট মেয়েরা সবার মুখ উজ্জ্বল করেছে। জাতীয় পর্যায়ে আলোকিত করেছে উপজেলার নাম। তাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।


আরও পড়ুন

×