- সারাদেশ
- বিএনপির বর্জনেও ভোটে জামায়াত, নেই বন্ধুত্ব
সিটি নির্বাচন
বিএনপির বর্জনেও ভোটে জামায়াত, নেই বন্ধুত্ব

জোটের পর এবার বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বন্ধুত্বও ভেঙেছে। দল দুটির অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগও আর নেই। নির্বাচন ও আন্দোলন ইস্যুতে দুই মেরুতে তাদের অবস্থান। বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার নীতিতে বিএনপি কঠোর হলেও, জামায়াতকে নমনীয় অবস্থানে দেখা যাচ্ছে। চার সিটি করপোরেশনে কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন নেতারা। বিএনপির যুগপৎ আন্দোলন থেকেও সরে গেছে দলটি। ভোটে অংশগ্রহণ এবং সমাবেশের অনুমতি চাইতে গিয়ে গত সোমবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কার্যালয়ের ফটক থেকে জামায়াতের চার নেতা আটকের তিন ঘণ্টার মধ্যে ছাড়া পাওয়ায় নতুন আলোচনা তৈরি হয়েছে। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ভুল তথ্যে পুলিশ তাঁদের ধরেছিল। জামায়াত নেতাদের ভাষ্য, মার্কিন নয়া ভিসা নীতির কারণে হয়তো তাঁদের ছাড়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের সঙ্গে সখ্যের প্রশ্নই আসে না। আর বিএনপির সঙ্গে গত কয়েক মাস কোনো পর্যায়েই যোগাযোগ নেই।
বিএনপিই তা বন্ধ করেছে।
আগামী ১২ জুন বরিশাল এবং খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। প্রার্থী হওয়া নেতাদের আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে কঠোর বার্তা দিয়েছে বিএনপি। তবে জামায়াত আছে ভোটে। বরিশালে দলটির চার নেতা কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন। খুলনায় দুই সাবেক কাউন্সিলরসহ ছয় নেতা ভোটে আছেন। রাজশাহীতে জামায়াতের সাতজন এবং সিলেটে বর্তমান দুই কাউন্সিলরসহ আটজন পদধারী নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। সিলেটে এর বাইরেও জামায়াত সমর্থক হিসেবে কয়েকজন প্রার্থী হয়েছেন। এ ছাড়া খুলনায় একজন ও রাজশাহীতে দুই জামায়াত নেত্রী সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন।
স্থানীয় জামায়াত নেতা ও প্রার্থীদের ভাষ্য, নির্বাচন করতে দলীয় নিষেধাজ্ঞা নেই। যদিও একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দলটি ঘোষণা দিয়েছিল বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। দলের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সমকালকে বলেছেন, জামায়াত এই সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে।
গত বছর অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও জামায়াতের নেতারা প্রার্থী হন। কয়েকটি পৌর নির্বাচনেও ছিলেন দলটির নেতারা। দলের নেতাদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে বিএনপি কঠোর হলেও জামায়াত কেন নমনীয়– প্রশ্নে ডা. তাহের বলেন, সব দলের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। বিএনপি তার মতো করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। জামায়াতকে কেন একই সিদ্ধান্ত নিতে হবে? স্থানীয় সরকার নির্বাচনে স্থানীয় ইস্যু, পাড়া-মহল্লার এবং পারিবারিক বিষয় থাকে। তাই জামায়াতের কেউ কেউ প্রার্থী হয়েছেন।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম একই দাবি করে বলেছেন, প্রার্থী হতে দলের অনুপ্রেরণা নেই। স্থানীয়ভাবে নিজ সিদ্ধান্তে জামায়াত নেতারা ভোট করছেন। প্রচারে দল তাঁদের সঙ্গে থাকবে না। গত বছর অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জামায়াতের এক নেতা মেয়র প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। মেয়র নির্বাচন দলীয়ভাবে হয় বলে দলের সিদ্ধান্ত মেনে তিনি প্রার্থী হননি।
সিটির ভোটে প্রার্থী দেওয়া সরকারের সঙ্গে সমঝোতা বা দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইঙ্গিত কিনা– প্রশ্নে দলটির নায়েবে আমির বলেন, সমঝোতার প্রশ্নই ওঠে না। জামায়াত অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বারবার বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া ভোটে অংশ নেবে না।
চার নেতাকে আটকের পরপর ছেড়ে দেওয়ায় ওঠা সরকারের সঙ্গে সমঝোতার গুঞ্জনকে নাকচ করলেও জামায়াত নেতারা বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে তাঁরা আর নেই। খালেদা জিয়া চেয়ারপারসনের দায়িত্বে থাকাকালে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার পর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত তাঁর সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। এখন তা আর নেই। দেশে থাকা বিএনপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ আগেও কম ছিল, এখন একেবারেই নেই। তারাও জামায়াতকে ডাকে না।
জামায়াতের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেছেন, আগামীতে বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন জোট হবে কিনা, তা অনিশ্চিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আদায়ের অবস্থা এখনও সৃষ্টি হয়নি। আগামী সংসদ নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত। নির্বাচন কমিশনের জামায়াতের তৈরি বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়ায় ভোটে অংশ নিতে নিবন্ধনের বিকল্প ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে কর্মীদের চাঙ্গা রাখা ও ভোট যাচাই করতে স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়া হচ্ছে। জাতীয় রাজনীতির ইস্যুর চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় সমর্থক সংগ্রহ, সাংগঠনিক কাঠামো মেরামত ও বিস্তারে সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হচ্ছে।
১৯৯৯ সালে জোট করে বিএনপি-জামায়াত। ২০০১ সালের নির্বাচনে জোটবদ্ধ হয়ে ভোট করে পরের পাঁচ বছর সরকার চালায়। বিএনপির মতো জামায়াতও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে। যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং তা ঠেকাতে সহিংসতার কারণে সমালোচিত জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে বিএনপির ওপর চাপ ছিল। তা অগ্রাহ্য করে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোট করে অংশ নেয় বিএনপি। নিবন্ধন হারানো জামায়াতের নেতারা বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হন। বিএনপি অপর জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে– এ ইস্যুতে সম্পর্কের অবনতি হলেও ভোটের পরও জোট টিকে ছিল কাগজে-কলমে।
গত বছরের আগস্টে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান দলীয় সভায় জানিয়েছিলেন জোট আর নেই। গত বছরের ৯ ডিসেম্বর সমঝোতার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বিলুপ্তি ঘটে। পরের দিন ঢাকার গণসমাবেশ থেকে ১০ দফা ঘোষণা করে বিএনপি। এর আধাঘণ্টা পর জামায়াতও নিজস্ব ১০ দফা ঘোষণা করে। কয়েকটি বাক্যের অমিল ছাড়া দুই দলের ১০ দফা ছিল অভিন্ন।
জামায়াতের একাধিক নেতা সমকালকে বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে জোটে থাকার কারণে তাদের ২০১০ সাল থেকে ধরপাকড় চলছে। দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সাজা হয়েছে। ১৩ বছরে শতাধিক নেতাকর্মী নিহত, পঙ্গু, নিখোঁজ হয়েছেন। লাখ খানেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার বা আসামি হয়েছেন। সারাদেশে সব কার্যালয় এক যুগ ধরে বন্ধ। তারপরও জামায়াত যুগপৎ আন্দোলনে ছিল।
১০ দফা ঘোষণার তিন দিন পর গ্রেপ্তার হন জামায়াতের আমির। দলটির নেতাদের ভাষ্য, আন্দোলনে শরিক হওয়ায় ডা. শফিক গ্রেপ্তার হন। জামায়াতের তরফ থেকে যোগাযোগ করা হলেও, বিএনপি তাঁর মুক্তির দাবি করা দূরে থাক, গ্রেপ্তারের নিন্দা পর্যন্ত করেনি।
গত ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বাইরে এবং ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণমিছিলের যুগপৎ কর্মসূচি ছিল। বিএনপিসহ অন্য দল পেলেও জামায়াতকে গণমিছিলের অনুমতি দেয়নি পুলিশ। তার পরও দলটি মিছিল করে। ২৪ ডিসেম্বরের কর্মসূচিতে জামায়াতের দুই শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। ৩০ ডিসেম্বর রাজধানীর মৌচাকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে দলটির কয়েক হাজার নেতাকর্মী আসামি হন। গ্রেপ্তার ও আহত হন অর্ধশতাধিক। বিএনপি এর প্রতিবাদ না করায়, যুগপৎ আন্দোলন থেকে সরতে শুরু করে জামায়াত।
জামায়াত নেতারা বলছেন, আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় দলের আমির ছয় মাস জেলে। সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার দেড় বছর কারাগারে। তিনি তিনবার জামিন পেলেও কারাফটক থেকে ফের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও কয়েক নেতাকে বারবার গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু বিএনপিকে কোনো ইস্যুতেই পাশে পাওয়া যায়নি। যুগপৎ আন্দোলনের জন্য সমমনা দলগুলো নিয়ে লিয়াজোঁ কমিটি করলেও, জামায়াতকে বাদ দিয়েছে। যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছে। এ কারণে জামায়াতও সরে এসেছে। তবে ডা. তাহের সমকালকে বলেন, জামায়াত আন্দোলন থেকে দূরে নেই। কারও দিকে না তাকিয়ে নিজের মতো কর্মসূচি পালন করছে।
মন্তব্য করুন