শুক্রবার বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা ছিল অন্তরের। বৃহস্পতিবার ছিল গায়ে হলুদ। অন্যদিকে পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে ৭ জুন মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা ছিল জুলহাসের। কিন্তু তার আগেই বাড়ি এলো তাদের লাশ। বুধবার ফরিদপুরের সদরপুরে নির্মাণাধীন ব্রিজের মাটি ধসে অন্তর-জুলহাসসহ ৩ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মাটিচাপা পড়ে আহত হন আরও চারজন।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে ফরিদপুর সদরের কৈজুরী ইউনিয়নের কবিরপুর গ্রামে নিহত অন্তর শেখের বাড়ি গিয়ে দেখা যায় পুরো এলাকা শোকে আচ্ছন্ন। প্রতিবেশীরা অন্তরের মা ঝর্না বেগমকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

অন্তরের মা বলেন, 'কাজে যাওয়ার দিন কাপড় চোপড় নিতে দেই নাই। বারবার বারন করছি ব্রিজের কাজে যাইস না। এখন আমারে কে বলবে -মা, তুমি খাইছো নাকি। ওরে আমার রাজপুত্র রে, তুই ঘরে আয়।'

প্রতিবেশী ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চাচাতো বোনের সঙ্গে শুক্রবার অন্তরের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। বাড়ি ফেরার কথা ছিল বৃহস্পতিবার বিকেলে। কিন্তু বুধবার রাতে বাড়ি ফিরেছে অন্তরের লাশ।

আজ সকাল ১০টায় কবিরপুর মধ্যপাড়া টাওয়ার জামে মসজিদে জানাজা শেষে অন্তরকে দাফন করা হয়।

নিজেকে সামলে নিয়ে অন্তরের মা বলেন, 'প্রায় ২ লাখ টাকা লোন করে ৪ শতাংশ জমি কিনে ঘর দিছি। বাপের সাথে কাজ করে অন্তরও লোন শোধ করতে সহায়তা করতো। এত কষ্ট কইরা জমি-ঘর হইছে কিন্তু আমার অন্তরই রইলো না।'

নিহত অন্তর শেখ

অন্তরের বাবা আফজাল শেখ (৪০) পেশায় রিকশাচালক। ছেলে হারালেও মামলা করেননি তিনি। এর কারণ জানিয়ে তিনি বলেন, 'মামলা কইরা তো আর ছেলেকে ফেরত পাব না। ছেলের শরীর কাঁটাছেড়া করা হোক, তা চাই না। এক ছেলে আগেই চইলা গেছে। দুইডা ছেলে নিয়া বাইচা ছিলাম। অন্তরও চইলা গেল। ছোটজনের কখন কী হইয়া যায়, জানি না।'

বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন মাটি চাপা

ছেলেকে মালয়েশিয়া পাঠাতে চড়া সুদে সাড়ে ৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন জুলহাসের বাবা ইসমাইল মীর। আগামী ৭ জুন তার ফ্লাইট ছিল। কিন্তু তার আগেই নির্মাণাধীন সেতুর মাটি ধসে চাপা পড়েছে মালয়েশিয়া যাওয়ার স্বপ্ন।

জুলহাসের বাড়ি গিয়েও একই চিত্র দেখা যায়। ছেলে হারানোর শোকে কাতর ইসমাইল মীর (৬০) একটু পর পর চোখের পানি ফেলছেন আর বলছেন, 'বাজান রে, বাড়ি আয় বাজান। তোর না জামাকাপড় কেনন লাগবো? তুই না মালোয়শিয়া যাবি? তোর না ৭ তারিখ ফ্লাইট? বাড়ি আয় বাজান।'

নিহত জুলহাস মীর

প্রতিবেশী মলিনা বেগম জানান, ৮ দিন আগে ব্রিজের কাজে যায় জুলহাস। বৃহস্পতিবার বিকেলে বাড়ি আসার কথা ছিল। তার আগেই লাশ বাড়ি এলো।

আজ সকালে কৈজুরী ইউনিয়নের তাম্বুলখানা শোলাকুন্ড কেরামতিয়া দাখিল মাদ্রাসায় জুলহাস মীরের (২৫) জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তাকে ফুকরা কবরস্থানে দাফন করা হয়।

ঠিকাদারের গাফিলতির অভিযোগ

মাটি ধসে ৩ শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় ঠিকাদারের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সহকারী সিদ্দিকুর রহমান নিহত দুই শ্রমিকের বাড়ি গিয়ে বৃহস্পতিবার সান্ত্বনা দিলেও কোনো সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দেননি।

স্বজনদের আহাজারি

ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ মো. ইশতিয়াক আরিফের ভাই ইমতিয়াজ আসিফের মালিকানাধীন মেসার্স আসিফ ইমতিয়াজ ৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যায়ে ২৫ মিটার ব্রিজটি নির্মাণ করছেন। তবে ঘটনার পর থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। 

সেতু নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরা জানান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বারবার জানালেও তারা মাটি সরানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। মাটির পাশে গাইড দেওয়ার কথা বলা হলেও তারা তা করেনি। উল্টো তারা শ্রমিকদের হুমকি দিয়ে কাজ করতে বাধ্য করছিল বলে অভিযোগ করেন তারা।

এ ঘটনায় আহত শ্রমিক আরিফ শেখ (৩৫) বলেন, 'কাজের জায়গাটি আগে থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। আগেই কিছু মাটি ধসে পড়েছিল। আমরা আপত্তি জানালেও তারা আমাদের কাজ করতে বাধ্য করে। আমরা প্রায় ১৬ জন কাজ করছিলাম। আমিসহ ৭/৮ জন শ্রমিক গাইডের মাটি সরিয়ে বেজে জায়গা করছিলাম। এ সময় আমাদের ওপর মাটি ধসে পড়ে।'

তদন্ত কমিটি

মাটি ধসে ৩ শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে (ভারপ্রাপ্ত ) মো. লিটন আলীকে প্রধান করে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৭ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়াও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্যেক পরিবারকে ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

কমিটির অন্যান্য সদস্য হলেন- গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী বরুন কুমার বিশ্বাস, সড়ক ও জনপদের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইমরান ফারহান সুমেল ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতিম সাহা।

অন্তরের মায়ের শোক ছুঁয়ে গেছে প্রতিবেশীদেরও

মামলা করেনি কোনো পরিবার

নিহত শ্রমিকদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা কেউই মামলা করতে আগ্রহী নন। তাদের ভাষ্য, মামলা করলে কেউ ফিরে আসবে না। এ ছাড়া ময়নাতদন্তে সন্তানদের লাশ কাটাছেঁড়া করা হোক, সেটাও চায় না পরিবার।

জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। এ ঘটনায় প্রকৌশলী, ঠিকাদার সবারই ব্যর্থতা আছে। তারা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে ৩ শ্রমিক এভাবে মারা যেত না। কার কী ব্যর্থতা আছে তা নির্ধারণ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করব।

প্রসঙ্গত, গত ৩১ মে সদরপুর উপজেলার ভাষাণচর ইউনিয়নের জমাদার ডাঙ্গী এলাকায় নির্মাণাধীন ব্রিজের মাটি চাপায় ৩ শ্রমিকের মৃত্যু হয়।

মৃত শ্রমিকরা হলেন- বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার উদয়পুর গ্রামের আল আমিন খাঁর ছেলে জাবেদ খাঁ (২৩), ফরিদপুর সদর উপজেলার কবিরপুর গ্রামের আফজাল শেখের ছেলে অন্তর শেখ (২২) ও কুফুরদিয়া গ্রামের ইসমাইল মীরের ছেলে জুলহাস মীর (২১)।

আহতরা হলেন– ফরিদপুর সদরের কুজুরদিয়া গ্রামের মনির খানের ছেলে সুমন খান (২৭), শোলাকুন্ডু গ্রামের রোকন মীরের ছেলে ওয়াহিদুল ইসলাম (৩০) এবং ঘোড়াদহ গ্রামের সিরাজ শেখের ছেলে রাসেল শেখ (২৫) ও মৃত খোলেক শেখের ছেলে নজরুল ইসলাম (৩০)।

/এমএইচটি/