সারের দাম এ বছরেই বাড়ে দুই দফা। দাম বাড়ার ফর্দে ছিল জ্বালানি তেল, বীজসহ সব কৃষি উপকরণ। এতে ফসলের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষককে পড়তে হচ্ছে গ্যাঁড়াকলে। এবার বোরোর বাম্পার ফলনেও ধানের দাম পাচ্ছেন না কৃষক। এমন উৎকণ্ঠার মধ্যে এসেছে নতুন বাজেট। আশা ছিল, কৃষকের উদ্বেগ প্রশমনে অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাব হবে উপযুক্ত রক্ষাকবচ। তবে তাঁর বক্তব্যে কৃষি যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে আগাম কর অব্যাহতির প্রস্তাব ছাড়া তেমন সুখবর নেই। মোট বাজেটের মাত্র ৫ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে কৃষি খাতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজেটে কৃষি বরাবরাই গতানুগতিক। কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় নতুন কিছু নেই।

আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি খাতে (কৃষি, খাদ্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ) ৩৫ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এই বরাদ্দ ছিল ৩৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রস্তাবনায় এ খাতে ১ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ডের মাধ্যমে চাষিদের কৃষি উপকরণ ও ঋণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। কার্ডধারী চাষির সংখ্যা বর্তমানে ২ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, পাহাড়ি ঢল ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষকদের ভর্তুকির পাশাপাশি প্রণোদনা ও পুনর্বাসন সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কৃষি খাতে অবদানের জন্য সরকার কৃষি খাতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ‘এআইপি’ সম্মাননা পদকের প্রবর্তন করেছে।

কৃষকের জন্য পুরোনো যেসব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, তা আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ফসলের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে আমরা সাশ্রয়ী মূল্যে সার, বীজ ও অন্য উপকরণ এবং সেচ সুবিধা দিচ্ছি। কৃষককে সাশ্রয়ী মূল্যে সার সরবরাহের জন্য সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। সেচ কাজে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলে ২০ শতাংশ হারে রেয়াত দেওয়া হচ্ছে। আমরা উচ্চফলনশীল জাতের ফসলের আবাদ বাড়িয়েছি। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য হাওর ও উপকূলীয় এলাকায় ৭০ শতাংশ ও অন্যান্য এলাকায় ৫০ শতাংশ উন্নয়ন সহায়তায় ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের কার্যক্রম চালাচ্ছি।

অর্থমন্ত্রী বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমরা ‘কৃষি খাত উন্নয়নে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা ২০২২’ প্রণয়ন করেছি। আমরা লবণাক্ততাসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতাসহিষ্ণু ধানের চাষ করছি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূপ্রকৃতিগত বিভিন্নতা বিবেচনায় নিয়ে ফসলের নিবিড়তা বাড়ানো হয়েছে। ভাসমান কৃষি, ছাদ কৃষি, হাইড্রোপনিক ও অ্যারোপনিক কৃষি কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

অর্থমন্ত্রী বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো উন্নত সংরক্ষণ ব্যবস্থা। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, খাদ্যশস্য সংরক্ষণ ক্ষমতা বিদ্যমান ২১.৮ লাখ টন থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৩৭ লাখ টনে উন্নীত করার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ নিয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়, বদ্ধ জলাশয় ও সম্প্রসারিত সামুদ্রিক জলাশয়ের উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনার জন্য সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি কাজে ব্যবহৃত রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার, ড্রায়ার প্ল্যান্টার, সব ধরনের স্প্রেয়ার মেশিন ও পটেটো প্ল্যান্টার আমদানির ক্ষেত্রে আগাম কর অব্যাহতির প্রস্তাব করা হয়েছে।

কৃষি বাজেট নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষি খাতে অনেক বেশি বরাদ্দ দেওয়ার দরকার ছিল। সেটি দেওয়া হয়নি। গত বছরের চেয়ে মাত্র ১ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ বেড়েছে। গত বছর ভর্তুকি প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছিল, রিভাইজ বাজেটে তা প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছিল। গত বছরের চেয়ে এবার সব কৃষি উপকরণের দাম বেড়েছে। ফলে আমরা আশা করেছিলাম, কৃষকের স্বার্থে গত বছরের চেয়ে বেশি ভর্তুকি রাখা হবে। তবে এবার প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি রাখা হয়েছে। মূল বাজেট বেড়েছে ১০ দশমিক ২ শতাংশ হারে। আর কৃষি বাজেট বেড়েছে ৩ দশমিক ২১ শতাংশ হারে। কৃষি বাজেট যে হারে বেড়েছে, তাতে আমাদের মূল্যস্ফীতির রেট কভার করছে না। কৃষকের জন্য যে পরিমাণ ভর্তুকি আশা করেছিলাম, সে পরিমাণ বাড়ানো হয়নি।

তিনি বলেন, কৃষি জীবনচক্রে যথাযথ রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বহুমাত্রিক সুফল জনগণ পেয়েছে। তবে এখন সংকট দেখা দিয়েছে কৃষকের স্বার্থরক্ষা নিয়ে। কৃষক কী করে তাঁর উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবেন, সেটা নিশ্চিত করা। তবে দুঃখের বিষয়, এসব দিকে রাষ্ট্রীয় নীতির বিরাট ঘাটতি রয়েছে।