- সারাদেশ
- তিন মসলায় ২২ বছরের গবেষণার ফল শূন্য
তিন মসলায় ২২ বছরের গবেষণার ফল শূন্য

বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার রহবল এলাকার কৃষক আব্দুস সাত্তার প্রতিবছরই আদার চাষ করেন এক বিঘা জমিতে। আগে আদার ফলন হতো বিঘায় তিন মণ। এখন সেই জমিতে ফলন হচ্ছে ছয় মণ পর্যন্ত। পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও বিঘাপ্রতি উৎপাদন বেড়েছে আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। হলুদ-রসুনের উৎপাদনও বেড়েছে বলে জানান একই এলাকার কৃষক মোহাম্মদ আলী। তবে বিপরীত চিত্র জিরার ক্ষেত্রে। মাত্র ১০ শতক জমিতে পরীক্ষামূলক জিরার চারা বুনেছিলেন, চারা গজানোর পর আট মাসের মাথায় যখন ফুল বের হবে, সে সময়ই জিরার গাছ মরে যায়। এভাবে তিনবার চেষ্টা করেও জিরা চাষাবাদে সুফল পাননি কৃষক আব্দুস সাত্তার।
এ দুই চাষির মতো কৃষকরা মসলা গবেষণা কেন্দ্রের গবেষণার মাধ্যমে আদা, পেঁয়াজ, রসুন ও হলুদ চাষ করে সুফল পেলেও জিরা, এলাচ ও দারচিনি চাষে এখনও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ২২ বছরের গবেষণার ফল শূন্যের কোঠায় বলছেন সংশ্লিষ্টরা। শিবগঞ্জ উপজেলার অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা মোসলেমা খাতুন বলেন, গবেষণার মাধ্যমে আগের চেয়ে ফলন বেশি হওয়ায় চাষাবাদে জমি ও উৎপাদন বেড়েছে আদা, রসুন ও পেঁয়াজে। কিন্তু জিরার পরীক্ষামূলক চাষাবাদে সুফল মিলছে না।
উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি কমাতে ১৯৯৬ সালে দেশের একমাত্র মসলা গবেষণা কেন্দ্রটি বগুড়ার শিবগঞ্জে স্থাপন করা হয়। তবে ২০০০ সাল থেকে গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদন শুরু হয়। সেখানে গবেষণার মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় মসলার মধ্যে পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এলাচ, জিরা ও দারচিনিতে গবেষণায় সুফল মিলছে না। ফলে চাষাবাদে পেঁয়াজ, আদা ও রসুনে আমদানি কমানো গেলেও এলাচ, জিরা ও দারচিনি জাতীয় মসলা আমদানি প্রতিবছরই বাড়ছে। তবে গবেষকদের দাবি, মসলার ৫১টি জাত উদ্ভাবন করতে পেরেছে এ কেন্দ্র, যা ইতোমধ্যে চাষাবাদ শুরু হয়েছে।
৭০ একর জমির ওপর স্থাপন করা দেশের একমাত্র মসলা গবেষণা কেন্দ্রটি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। এ কেন্দ্রের অধীনে তিনটি আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র এবং চারটি উপ-আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। আঞ্চলিক মসলা কেন্দ্র মাগুরা, কুমিল্লা ও গাজীপুরে। উপ-আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র লালমনিরহাট, ফরিদপুর, সিলেট ও খাগড়াছড়িতে। তথ্যমতে, এ পর্যন্ত ৪৬টি মসলা ফসল নিয়ে গবেষণা করে ১৫৬টি মসলা ফসলের প্রযুক্তি ও ৫১টি জাত উদ্ভাবন হয়েছে। এর মধ্যে পেঁয়াজের সাতটি, পাতা পেঁয়াজের একটি, মরিচের চারটি, অর্নামেন্টাল মরিচের দুটি, রসুনের চারটি, আদার তিনটি, হলুদের পাঁচটি, ধনিয়ার দুটি,
বিলাতি ধনিয়ার একটি, কালিজিরার একটি, মেথির তিনটি, ফিরিঙ্গি একটি, মৌরির দুটি, শলুক একটি, রাঁধুনি একটি, জাউন একটি, একাঙ্গির একটি, চিভের একটি, পুদিনার দুটি, আলুবোখারার একটি, দারচিনি একটি, তেজপাতা একটি, গোলমরিচের একটি, পানের তিনটি এবং জিরার একটি জাত। এর মধ্যে জিরা, দারচিনি ও এলাচ ছাড়া অন্যান্য জাতের উদ্ভাবন করা মসলার চাষ করছেন কৃষকরা।
মসলা গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী পেঁয়াজ, রসুন ও আদা ছাড়া দেশে বছরে মসলার মোট চাহিদা ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন। এর মধ্যে আমদানি হয় প্রায় ৪৫ লাখ টন। এর পরও ঘাটতি থেকে যায় আরও প্রায় সাড়ে ১৩ টন। বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের মাধ্যমে যে ৫১টি জাত উদ্ভাবন করে চাষাবাদ করা হচ্ছে, সেই খাতে আমদানি কমেছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া আদা, পেঁয়াজ, রসুন ও হলুদের উৎপাদন বাড়ায় এ খাতে আমদানি আগের তুলনায় কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ।
কৃষি অধিদপ্তর বগুড়ার অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) এনামুল হক বলেন, গবেষণার কারণে দেশে আদা, পেঁয়াজ, রসুন ও হলুদের চাষাবাদ ও উৎপাদন আগের তুলনায় বেড়েছে। কিন্তু এসব ফসলের মধ্যে আদা চাষে সময় লাগে প্রায় ১০ মাস, ফলে এতে কৃষকের তেমন আগ্রহ নেই।
মসলা গবেষণা কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আশরাফুল আলম বলেন, দেশে মাত্র আড়াই শতাংশ জমিতে মসলা চাষ করা হয়। একেক এলাকার মাটি একেক ধরনের মসলা উৎপাদনের জন্য উপযোগী। এ মসলা গবেষণা কেন্দ্র বর্তমানে জিরা, দারচিনি, ইসবগুল, উচ্চ মূল্যের ভ্যানিলাসহ মসলা ফসলের আরও নতুন জাত উদ্ভাবনের ওপর গবেষণা কাজ চলছে।
এ কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. জুলফিকার হায়দার বলেন, এ গবেষণা কেন্দ্রে বিশাল পরিসরে গবেষণা কাজ পরিচালনার জন্য কমর্রত বিজ্ঞানীর সংখ্যা অপ্রতুল। দক্ষতা বাড়াতে ফেলোশিপ ও উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নেই।
মন্তব্য করুন