
আবিদদের বাড়ির সামনে কী সুন্দর সবুজ ঘাস। বৃষ্টির পানি পেয়ে লকলক করে বেড়ে উঠেছে। আবিদদের কোনো গরু বা ছাগল নেই যে, ঘাসগুলো খাবে। আবিদ বাবাকে কতো বলেছে একটি গরু কিংবা ছাগল ছানা কিনে আনতে। বাড়ির পালানে এতো এতো ঘাস। খেয়ে কুল পাবে না। কিন্তু বাবা তার কথায় কান দেননি। বলেছেন, ওসব উটকো ঝামেলা। তাছাড়া আমার সময়ই বা কোথায়!
শুক্রবার। ইশকুল বন্ধ। সকালবেলা। আবিদ রান্নাঘরের বারান্দায় বসে কতো কী ভাবছে। হঠাৎ দেখে, বাইরের বাঁশের চটার গেট খুলে ভেতরে ঢুকছে বন্ধু আবির। তার সাথে একটা ছাগল ছানা। গলায় দড়ি বাঁধা, তার এক মাথা আবিরের হাতে ধরা। মুহূর্তে আবিদের মন খুশিতে ভরে যায়। এক লাফে বারান্দার নিচে নামে।
– আ রে দোস্ত, একে কোত্থেকে আনলি? আহ্ কী সুন্দর দেখতে!
– আব্বা কাল রাতে পাশের গ্রাম শেখেরাবাথান থেকে কিনে এনেছেন আমার জন্য।
– তোর জন্য?
– হ্যাঁ, আমার জন্য। সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে কিনেছেন। আমি ইশকুলে যাওয়ার আগে আর ইশকুল থেকে এসে ওকে ঘাস খাওয়াবো। পেলেপুষে মানুষ করবো! তোদের বাড়ির সামনে কত ঘাস। আধঘণ্টা খেলেই তো ওর পেট ভরে যাবে। দেখিস, ছয় মাসের মধ্যেই ও বাঘের বাচ্চা হয়ে যাবে!
আবির ছাগল ছানাটাকে ঘন ঘাসের জঙ্গলে ছেড়ে দেয়। অভ্যেসবশত সে ঘাসে মুখ দেয়। খায়ও একটু। তারপর কী যে হলো ওর। হঠাৎ ম্যা ম্যা চিৎকার জুড়ে দেয়। ঘাসেও মুখ দেয় না। খালি চিৎকার– ম্যা ম্যা। আবিদ আর আবির তো অবাক। ওদের আনন্দ-খুশি উবে যায় মুহূর্তে। হঠাৎ কী হলো ছানাটার! ওরা ছাগল ছানার মাথায় হাত বোলায়। আদর করে। তাতে যেন ওর চিৎকার আরও বেড়ে যায়। ম্যা ম্যা বলে চারদিক কাঁপিয়ে তোলে।
আবির ছাগল ছানার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, মায়ের জন্য পরাণ পুড়ছে, বাবু? তা প্রথম প্রথম একটু পুড়বেই। তারপর দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। আমাদের সাথে খেলবে। সবুজ তাজা ঘাস খাবে। দেখবে, কদিন পরে মায়ের কথা আর মনেই পড়বে না।
ছাগল ছানাটা আবিরের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর মানুষের মতো করে বলে, এ কী কথা বললে আবির ভাই! মা তো মা-ই। মায়ের জন্য পরাণ পুড়বে না! মাকে কী কখনো ভোলা যায়?
আবির কী জবাব দেবে ভাবছে। আবিদ বলে, দোস্ত, এনিথিং রঙ? কী অতো ভাবছিস? ছাগল ছানাটাই-বা তোর দিকে তাকিয়ে অতো কি বললো এতোক্ষণ? ও কী বললো?
ততোক্ষণে ছানাটা আকাশ ফাটিয়ে ফের চিৎকার জুড়ে দেয়–ম্যা ম্যা ম্যা।
– ছানাটা ওর মায়ের জন্য কাঁদছে।
– তাই নাকি!
– হ্যাঁ, সত্যি তাই। এই যে এতো এতো ঘাস, কিছুই ওর ভালো লাগছে না। ও আমাকে বলেছে, ওর মায়ের জন্য পরাণ পুড়ছে। মাকে কখনো ভোলা যায় না। ও এসব কথাই আমাকে বলেছে। তুই শুনতে পাসনি।
আবিদ চোখ বড়ো করে আবিরের কথা শুনছে। ততোক্ষণে ছানাটা ম্যা ম্যা বলে চিৎকার করতে করতে গেট পেরিয়ে রাস্তায়। আবিদ আবিরকে ঝাঁকি দিয়ে বলে, এই আবির, ছানাটা তো পালিয়ে যায়।
আবিদের কথা আবির যেন শুনতেই পাচ্ছে না। ওর চোখে তখন ভাসছে অন্য দৃশ্য– বাবুটা তার মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মা ওকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে। গা-মাথা চেটে দিচ্ছে। আর বলছে, বাবা সোনা আমার! তুই ফিরে এসেছিস! চল, বাছা, বাড়ির পালানে চল। ঘাস খাবি পেট ভরে। অমনি মায়ের সাথে নাচতে নাচতে বেরিয়ে যাচ্ছে ছানাটা।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে এক চিলতে হাসি ফোটে আবিরের ঠোঁটে। তা দেখে আবিদ বলে, কী আশ্চর্য, ছাগল ছানাটা পালিয়ে গেলো আর তুই কিছুই করলি না, উলটো হাসছিস?
আবির মুখ গম্ভীর করে বলে, আমার তো মা নেই, তাই বুঝি মা না থাকার যন্ত্রণা। ও গিয়েছে ভালোই করেছে। ও মায়ের আদর পাক, তাতেই আমি খুশি।
গলা ধরে আসে আবিরের। চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় গড়িয়ে পড়ছে পানি। তাতে গালমুখ ভিজে যাচ্ছে ওর।
বিষয় : মাকে ভোলা যায়? গল্প মুস্তাফা মাসুদ রজত
মন্তব্য করুন