‘বছরে বছরে নদী ভাঙে। হামার ৩টা ঘর ভাঙি গেইছে। মাইনষের জাগায় যায়া থাকি। পানি দেখি মনে হয়, এবার আগত বান (বন্যা) আইসবে। হামাক ভিটেমাটি কোনা বান্দি দেও।’

বলছিলেন কুড়িগ্রামের রাজাহাটের তিস্তাপাড়ের বাসিন্দা কোহিনুর বেগম। তাঁর মতো তিস্তাপাড়ের অনেক বাসিন্দাই নদীভাঙন আর বন্যার শঙ্কায় রয়েছেন।

কুড়িগ্রামে গত এক সপ্তাহের মধ্যে তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্রসহ বেশ কয়েকটি নদ-নদীর পানি ক্রমেই বেড়ে যাওয়ায় নদীতীরবর্তী অঞ্চলে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন ও আগাম বন্যার আশঙ্কা। দুই সপ্তাহ পার হলেই শুরু হবে বর্ষা মৌসুম। নদ-নদীর পানি ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত এক সপ্তাহে জেলা সদর, চিলমারী, উলিপুর ও রাজারহাট উপজেলার কয়েক জায়গায় ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ভাঙনে এ চার উপজেলায় ইতোমধ্যে দুই শতাধিক স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।  

গত মঙ্গল ও বুধবার ভাঙন এলাকাগুলো ঘুরে দেখা যায়, মানুষজন নিজেদের বসতভিটা, জমি হারিয়ে অনেকটা নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। অনেকে আগাম বন্যার আশঙ্কায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে। বসতভিটার পাশে থাকা গাছ কেটে সরিয়ে নিচ্ছে।

রাজারহাট উপজেলার তিস্তাপাড়ের গতিয়াশাম এলাকাতেও ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ এলাকায় ২০টির মতো বাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে।

এলাকার বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম বলেন, ১০-১২ দিন থেকে তিস্তার পানি বাড়ছে। তাঁদের তিনটি ঘর নদীতে ভেঙে গেছে। বাড়ির সামনে ভুট্টার আবাদের সাড়ে ৩ শতাংশ জমির মাটি নদীতে চলে গেছে।

আরেক বাসিন্দা মো. রুবেলের ভাষ্য– ‘তিস্তার পানি যেভাবে বাড়তেছে তাতে এবার আগত বন্যা হবার পায়। পানি বাড়ার কারণে নদীত ভাঙন দেখা দিছে। হামার এই দুইটা পাকা ঘর ভাঙি সরে নিবাইছি, যাতে ইটগুলা রক্ষা করবের পাই।’

গত এক সপ্তাহে জেলা সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের ধরলা নদীর ভাঙনে চর ভগবতীপুর, খেয়ার আলগায় ৪০টি পরিবার বসতভিটা হারিয়েছে। ভেঙেছে মসজিদ, উপজেলা প্রশাসনের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্থাপনা ও সরকারি একটি কমিউনিটি ক্লিনিক।

এই ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর বলেন, গত এক সপ্তাহের ভাঙনে তাঁর এলাকার অর্ধশত মানুষ সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। ভাঙন না থামলে আরও অগণিত বসতি নদীতে চলে যাবে। পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে এবার আগাম বন্যার আশঙ্কা আছে। ভাঙনের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা ভগবতীপুর কমিউনিটি ক্লিনিক গত বুধবার নদীতে চলে গেছে।

উলিপুর ও চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে দিশেহারা হয়েছে চরের অনেক বাসিন্দা। এ দুই উপজেলার বেগমগঞ্জ, থানাহাট, নয়ারহাট ও রানীগঞ্জ ইউনিয়ন ইতোমধ্যে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনের মুখে পড়েছে। অব্যাহত ভাঙনের ফলে এসব ইউনিয়নের চরের বসতি ছোট হয়ে আসছে। এসব চরের মসজিদ, স্কুলসহ শতাধিক বাড়িঘর ভাঙনের কবলে পড়েছে। আরও তিন-চারশ বাড়িঘর আছে ভাঙনের হুমকিতে। এর মধ্যে নয়ারহাট ও রানীগঞ্জের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

চিলমারীর চর বড়ভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন, গত বন্যায় তাঁদের স্কুলটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এ বছর যেভাবে ভাঙন শুরু হয়েছে, তাতে আগাম বন্যা হলে খুব সমস্যা হবে। এবার স্কুলটি কোথায় নিয়ে যাবেন, কী করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। দ্রুত ভাঙন থামানো না গেলে স্কুলটি রক্ষা করা যাবে না।

বেগমগঞ্জের বাসিন্দা সামসুল মণ্ডল বলেন, গত কয়েক দিনের ভাঙনে শতাধিক বাড়িঘর ব্রহ্মপুত্রে বিলীন হয়ে গেছে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে। যারা সহায়-সম্বলহীন তাদের হুমকি জেনেও থাকতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ভাঙন ঠেকানো না গেলে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা আছে।

চলমান ভাঙন প্রতিরোধ বিষয়ে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, উজানের ঢলে ব্রহ্মপুত্রে পানি বাড়ছে। আর কয়েক সপ্তাহ গেলেই বন্যার আশঙ্কা দেখা দেবে। এ অবস্থায় চর ভাঙাই স্বাভাবিক। এক চর ভেঙে আরেক চর গড়ে ওঠে। চরাঞ্চলের ভাঙন প্রতিরোধে তাঁদের কোনো প্রকল্প নেই। সমীক্ষা ছাড়া প্রতিরক্ষা কাজ সম্ভব নয়; করলেও টিকবে না। এর পরও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা চাইলে তাঁরা কিছু জিও ব্যাগ দিতে পারেন। তবে সেগুলো নিজ উদ্যোগে বালু ভরিয়ে নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, চরের ভাঙন প্রতিরোধে প্রাথমিক নদী সংরক্ষণ কাজ বাস্তবায়নের ১৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দের চাহিদা প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সরকারি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো রক্ষায় তাঁরা প্রতিনিয়ত জিও ব্যাগ ফেলছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হয়েছে।