- সারাদেশ
- ঢাকায় হাওয়া বদল
ঢাকায় হাওয়া বদল

নদীর পাড়ে দু’কদম হাঁটলেই হাওয়া ছুটে আসে। আছড়ে পড়ে গায়ে। প্রশান্তি দোল খায় মনে। রাজধানী ঢাকা এক-দুটি নয়, ছয়টি নদী অধ্যুষিত শহর। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এর রাজধানী বংশী, তুরাগ, বালু, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যাবেষ্টিত। ঢাকার সীমানা ও পরিধি গড়ে দিয়েছে এসব নদী। উপরন্তু উপশিরার মতো এই নগরের আছে ৭৫টি খাল। ‘আছে’ অবশ্য আর বলা যাচ্ছে না। খালের সংখ্যা বড় গোলমেলে এখন। ওয়াসা বলবে ২৬টি, ঢাকা জেলা প্রশাসন বলবে ঢাকায় খালের সংখ্যা প্রায় ৫৬টি। কেউ বলছে, নগরে খুঁজে ৫০টি খালের অস্তিত্ব মিলেছে। খাল রক্ষায় শত-হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হচ্ছে। এরই ফাঁকে নড়াই নদী কারও কাছে হয়েছে রামপুরা খাল, কারও কাছে বেগুনবাড়ী খাল।
কথা ছিল, ঢাকার অলিগলিতে ঘুরপাক খাবে জলজ শীতল হাওয়া। তা না, ঢাকাকে এখন লোকে তাপীয় দ্বীপ বলছে। গ্রীষ্মে ঢাকায় ৩৩ থেকে ৩৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা প্রত্যাশিত। অথচ কোনো দিন ৩৮, কোনো দিন ৪০ ছুঁইছুঁই তো কোনো দিন ৪০ ডিগ্রি পেরিয়ে যাচ্ছে ঢাকার তাপমাত্রা। ঘূর্ণিঝড় মোকা দু-চার দিন সামান্য স্বস্তি দিয়েছিল। এরপর আবারও রোদ চড়ছেই। মানুষ যেন গলে যাচ্ছে গরমে। বৃষ্টির আশায় পথের চারপেয়ে প্রাণীরাও কাতর। এ শহরে বৃষ্টি যেন দুরাশা।
জেমস টেলরের টপোগ্রাফি অব ঢাকা বইটির প্রকাশকাল ১৮৪০ সাল। এর অনুবাদ গ্রন্থ কোম্পানি আমলের ঢাকা বলছে, ওই সময়ের ঢাকার আবহাওয়ায় আজকের নাভিশ্বাস ছিল না। এখন বছরের মাঝামাঝিতে তাপমাত্রার বাড়বাড়ন্ত হলেও তখনকার আবহাওয়ার আভাস দিয়ে বইটিতে লেখা আছে– এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাই মাসে সাধারণত দিনের প্রথমার্ধে এবং রাত্রিকালে শান্ত বায়ু প্রবাহিত হয়।
ওই শান্ত বায়ু তখন গড়ে দিত নদী। বইটিতেও বলা হয়েছে সে কথাই– এ বায়ুপ্রবাহ নদীনালার ওপর দিয়ে অতিক্রম করার কারণে এতে প্রচুর জলীয় বাষ্প সংমিশ্রিত থাকে। তা অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা ও মনোরম থাকে।
মোগল আমলে সবার আকর্ষণ ছিল বুড়িগঙ্গা। বলা চলে, বুড়িগঙ্গার পাড় ছিল অভিজাত এলাকা। সম্ভ্রান্তদের মনোবাসনায় থাকত বুড়িগঙ্গার তীরে একটি বসতি। রবিঠাকুর ১৯২৬ সালে ঢাকা এসে তুরাগ বোটে উঠেছিলেন। নদীর হাওয়ার মর্ম বুঝতেন তাঁরা।
নদীপাড়ের ঢাকাকে তিলোত্তমা করে তোলার গাল ভরা বুলি বহুবার শোনানো হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, ঢাকা অবহেলিত রয়েছে যুগ যুগ ধরে। সেই সঙ্গে নদীকে পেছনে ঠেলে গড়ে উঠেছে আবাসন প্রকল্প। সত্তরের দশকের ঢাকায় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো ছিল না বলে দূষিত হতো নদী। এখন নদীতে যোগ হচ্ছে শিল্পবর্জ্য।
কাকরাইল, শান্তিনগর, মালিবাগ এলাকাকে গাছপালাঘেরা গ্রাম বললে তা হাস্যকর উপমা শোনাবে। অথচ মীজানুর রহমান ‘ঢাকা পুরাণ’ বইটিতে এই এলাকাগুলোকে ‘তরুরাজিসম্পন্ন বাংলার সনাতন গ্রাম’ বলেছেন। এই শহরের হাওয়ায় কখনও যে শীতলতা ছিল, এ কথা আজ অবিশ্বাস্য শোনালেও ঢাকা পুরাণ বইটির পাতায় সেই হাওয়ার পরশ। স্মৃতিচারণে লেখক বলছেন, ‘পুরানা পল্টন ছাড়িয়ে কাকরাইলমুখো হতেই গ্রামের নির্মল পাগল হাওয়া ঝাপ্টা দিয়ে যেত চোখে-মুখে।’
১৯ শতকে ঢাকায় লাখখানেক মানুষের বসতি ছিল। সেই ঢাকা এখন মেগাসিটি। এখন এই নগরে দুই কোটিরও বেশি মানুষের বাস। ঢাকার চারদিকে উড়ছে নগরায়ণের ধুলা। ঢাকা নিয়মিত নাম লেখাচ্ছে দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায়। ঢাকার উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে গত দু-তিন দশকে গাছ কাটা পড়েছে বহুবার। আজ যেখানে দাঁড়িয়ে নদী উদ্ধারের কথা বলি, সেখানেও ছিল জলস্রোত। সেই ঢাকা হারিয়ে গেছে। পুকুর চুরি তো আগে হতো; এখন খাল চুরি, নদী চুরি, সবুজ চুরি হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন-প্রতিরাতে এই নগর থেকে।
আশির দশকে কবি নবীনচন্দ্র সেন বলেছিলেন, ঢাকা দেখে বিন্দুমাত্র সুখী হতে পারেননি তিনি। ঢাকা নামের এই নামকাওয়াস্তে তিলোত্তমায় আমরাও তো সুখে নেই। গরমে ছেলেবুড়ো পাগলপ্রায়। নদীপাড়ে ছুটব, সে নদী কোথায়? বৃক্ষতলে বসব, সে সবুজের ছাদ কোথায়?
এককালে অসুখ হলে ডাক্তারবাবুরা অ্যান্টিবায়োটিক লিখতেন না। তখন বিশেষ দাওয়াই ছিল ‘হাওয়া বদল’। তপ্ত নগরী ঢাকার নাভিশ্বাস তোলা এই হাওয়া বদলের প্রেসক্রিপশন কে লিখবে? v
মন্তব্য করুন