যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন বুশরা আফরিনকে চিফ হিট অফিসার বা প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স ও ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্সের আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট হলে এক অনুষ্ঠানে এই নিয়োগের ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের শর্ত পূরণ করেই ৩ মে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান বুশরা। আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন বিশ্বের বিভিন্ন শহরে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় তাদের কাজের অংশ হিসেবে প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়। প্রতিষ্ঠানটি প্রথম প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয় ২০২১ সালে। বুশরার আগে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আরও সাত নারীকে প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়।

ঢাকার রেকর্ড তাপমাত্রা ও তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা
ঢাকার তাপমাত্রা যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এর শুরুটা গত এপ্রিলে। কেবল ঢাকাই নয়; ভয়াবহ তাপপ্রবাহের কবলে পড়ে পুরো দেশ। কয়েক জেলায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। আর ঢাকার তাপমাত্রার পারদ চড়ে রেকর্ড ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। রেকর্ডের খেরো খাতা খুললে দেখা যায়, রাজধানীতে এটি গত ছয় দশকের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। বিশ্বব্যাংকের ২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, দেশের আগামীর দিনগুলো এমন আরও ভয়াবহ তাপপ্রবাহের কবলে পড়বে। এমনই এক সংকটে ৩ মে বুশরা আফরিন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ‘চিফ হিট অফিসার’ বা প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তার দায়িত্ব পান। বুশরা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মিয়ামি, সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউন, গ্রিসের এথেন্স, চিলির সান্তিয়াগো, মেক্সিকোর মনট্রে ও অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তারা কাজ করছেন।


জন্ম ও বেড়ে ওঠা
বুশরার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার আলো-হাওয়া গায়ে মেখেই। স্কুলের পাঠও নেন ঢাকাতেই। তবে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে পাড়ি জমান কানাডায়। সেখানেই উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে উচ্চশিক্ষা নেন গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে। ঘানার ইনস্টিটিউট অব লোকাল গভর্নমেন্টেও লেখাপড়া করেন বুশরা। তখনই ঘানার বলগাটাঙ্গায় একটি নারী উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ শুরু করেন। এক সময় দেশে ফিরে বেসরকারি একটি উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী হিসেবে কাজ করেন। দেশের প্রাণী অধিকার সংস্থা অভয়ারণ্যের পলিসি কনসালট্যান্ট হিসেবে ডিএনসিসির সঙ্গে কাজ করেছেন। সৃজনশীল বুশরা চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেছেন। নুহাশ হুমায়ূনের ‘মশারি’ ছবির অন্যতম প্রযোজক তিনি। পাঁচ বছর আগে নুহাশের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘৭০০ টাকা’র একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করতেও দেখা যায় বুশরাকে।

জনসচেতনতাই প্রধান কাজ
প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাড্রিয়েন আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ১০০ কোটি মানুষকে চরম তাপমাত্রা থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এই প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। কেবল তাপমাত্রার কারণেই প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয় না; বরং বিভিন্ন উদ্ভাবনী বিষয়ে শহরের মেয়র ও স্থানীয় সরকারের আগ্রহের বিষয় মাথায় রেখে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়। তীব্র তাপপ্রবাহের ফলে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলা এবং নগরে ‘হিট আইল্যান্ড’-এর প্রভাব কমানোর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন করাই প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তার কাজ। এ ছাড়া কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, ব্যক্তি, নাগরিক সমাজ, দাতাসংস্থাসহ সব পক্ষকে সম্পৃক্ত এবং সমন্বয় করার দায়িত্বও প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তার। প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তার আওতায় যেসব কাজ হবে, সেগুলোর অর্থায়ন করবে আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন। চিফ হিট অফিসারের বেতনসহ সব খরচও দেবে প্রতিষ্ঠানটি।

আরও যত প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা
২০৫০ সালে বিশ্বে উষ্ণ দিনের সংখ্যা দ্বিগুণ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর বড় বোঝা চাপবে নারী ও কন্যাশিশুর ঘাড়ে। এ জন্যই প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা পদে নারীকে নিয়োগ দেওয়া হয় বলে জানান অ্যাড্রিয়েন আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টারের পরিচালক ক্যাথি বাগম্যান ম্যাকলর্ড। বিশ্বের বিভিন্ন শহরে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার অংশ হিসেবে প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয় আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যার্ডিয়ান আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন। স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেন তাঁরা।

জেন গিলবার্ট: ২০২১ সালের মে মাসে বিশ্বের প্রথম প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা নিয়োগ পান জেন গিলবার্ট। তাঁর কর্মস্থল যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার মায়ামি শহরে। মায়ামির মেয়র তাঁকে প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন।
এলেনি মাইরিভিলি: ইউরোপের প্রথম ও বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা হিসেবে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের দায়িত্ব পান এলেনি মাইরিভিলি। এ বছরের মার্চ পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি জাতিসংঘের বৈশ্বিক প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা।

এলিসাভেট বারগিয়ান্নি: এলেনি মাইরিভিলি জাতিসংঘের বৈশ্বিক প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর মার্চে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এলিসাভেট বারগিয়ান্নি। এথেন্সের নগর প্রশাসনে দুই দশক ধরে কাজের অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। এ ছাড়া তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিগত ও আর্থিক খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে কাজ করে আলোচনায় আসেন।

ইউজেনিয়া কার্গবো: ২০২১ সালের নভেম্বরে আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওনের রাজধানী ফ্রিটাউনে প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান ইউজেনিয়া কার্গবো। কার্গবো এরই মধ্যে বৃক্ষরোপণ থেকে শুরু করে বর্জ্য সংগ্রহ এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছেন।

ক্রিস্টিনা হুইডুব্রো টর্নভাল: ২০২২ সালের নভেম্বরে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান ক্রিস্টিনা হুইডুব্রো টর্নভাল।

ক্রিস্টিনা মিলনে ও টিফানি ক্রফোর্ড: ক্রিস্টিনা মিলনে ও টিফানি ক্রফোর্ড অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে প্রধান তাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তার কাজ করছেন। তাঁরা যৌথভাবে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির শর্ত অর্জনের পাশাপাশি মেলবোর্নকে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং শূন্য কার্বন নিঃসরণের শহর হিসেবে গড়ে তোলার কাজ করছেন।

আগামীর স্বপ্ন
নিজের কাজ ও আগামীর পরিকল্পনা সম্পর্কে বুশরা আফরিন বলেন, ‘দরিদ্র দেশগুলোর অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহর জলবায়ু ও পরিবেশগত ভয়াবহ হুমকির মুখে রয়েছে। যদি ঢাকার দিকে তাকান তবে দেখবেন, ২ কোটি ২০ লাখের বেশি জনসংখ্যা নিয়ে ঢাকাও এই শহরগুলোর তালিকায় পড়ে। প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি মানুষ ঢাকায় আসছেন কেবল বসবাসের উদ্দেশ্যে। থাকার অন্য কোনো উপায় না পেয়ে অনেকেই বস্তিতে থাকছেন। এই বস্তিগুলোয় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও খাওয়ার পানির ঘাটতি আছে। তা ছাড়া বস্তির  ঘরগুলো তৈরি ধাতু দিয়ে। গরমে সেগুলো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। হয়ে যায় চুলার মতো। সরবরাহ লাইন দিয়ে আসা খাওয়ার পানিও প্রচণ্ড গরম হয়ে থাকে। তো দিন দিন বাড়তে থাকা জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে সংকটে পড়া ঢাকার তাপমাত্রা গ্রামাঞ্চলের চেয়ে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে যেতে পারে আগামীতে। সত্যি কথা বলতে সবাই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
শুধু আমার মেয়ের জন্য নয়; বরং সব শিশুর জন্য শীতল ও আরও সমতার একটি ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে কাজ করতে চাই।’