- সারাদেশ
- জাবিতে কমছে সবুজ, ধ্বংস জীববৈচিত্র্য
জাবিতে কমছে সবুজ, ধ্বংস জীববৈচিত্র্য

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষিত বনের জমিতে আইবিএ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে প্রশাসন। এর প্রতিবাদে সেখানে ‘গাছ কাটা নিষেধ’ ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা-সমকাল
পরিকল্পনা ছাড়া একের পর এক ভবন নির্মাণের ফলে কমছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাসের সবুজ। গত ৯ বছরে প্রায় ৮৫ একর জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে অবকাঠামো। এর অধিকাংশই প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে করা হয়েছে বলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে এসব অপরিকল্পিত ভবন। এর মধ্যেই নির্বিচারে গাছ ও প্রাণী হত্যার আরও আয়োজন চলছে।
২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত স্যাটেলাইট ইমেজ ডিজিটাইজ করে দেখা গেছে, ৬৯৭.৫৬ একর জায়গার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজায়ন ৩ শতাংশ ও জলাশয় ২ শতাংশ কমেছে এবং অবকাঠামো বেড়েছে ৫ শতাংশ। ২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজায়ন ছিল ৫৬ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে এসে হয়েছে ৫৩ শতাংশ। অর্থাৎ ২০ একর জমির সবুজায়ন কমেছে। এ ছাড়া ২০১৫ সালে অবকাঠামো ছিল ৬ শতাংশ, যা বর্তমানে ১১ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ ৩৪.৮৫ একর জমিতে অবকাঠামো নির্মাণ হয়েছে।
এদিকে সম্প্রতি সমাজবিজ্ঞান অনুষদের পেছনের বনভূমিতে এক্সটেনশন ভবন, মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনের বনভূমিতে স্পোর্টস কমপ্লেক্স ভবন, লাইব্রেরি সংলগ্ন জঙ্গলে নতুন লাইব্রেরি ও লেকচার থিয়েটার ভবন, স্কুল অ্যান্ড কলেজ সংলগ্ন টিচার্স কোয়ার্টার এবং টিচার্স ক্লাব সংলগ্ন জঙ্গলে গেস্ট হাউস ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। এসব স্থান মিলিয়ে আনুমানিক ৫০ একরের বেশি সবুজায়ন ধ্বংস করে অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে, যা সাম্প্রতিক স্যাটেলাইট ইমেজ না থাকায় ডিজিটাইজ করা সম্ভব হযনি। সব মিলিয়ে এ সময়ের মধ্যে প্রায় ৮৫ একর সবুজায়ন ধ্বংস করে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যদিকে, জলাশয়ের পরিমাণ ৩৮ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৩৬ শতাংশ।
কোপ পড়বে জাবির ‘সুন্দরবনে’
সম্প্রতি তিনটি ইনস্টিটিউট ভবন নির্মাণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জীববৈচিত্র্যে ভরপুর সংরক্ষিত বনভূমির ২০ বিঘা জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞান কারখানা সংলগ্ন ওই এলাকা জাবির ‘সুন্দরবন’ নামে পরিচিত। সেখান আইবিএ ভবনের জন্য ৮ বিঘা, ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং অ্যান্ড জিআইএস এবং বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের ভবন নির্মাণের জন্য ৬ বিঘা করে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে ভবন নির্মাণের জন্য গত ২৩ মে আইবিএর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ওই বনায়নের কয়েকশ গাছ কাটা পড়ার শঙ্কা করা হচ্ছে।
উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বরাদ্দ দেওয়া ওই অঞ্চলে আছে প্রায় ১৫০ প্রজাতির গাছ। এর আগে ২০২১ সালের ৭ এপ্রিল এই সংরক্ষিত বনভূমির ১৫ একর জায়গা আগুনে পুড়েছিল। পরে সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ এবং ব্যাঙ, শামুক, টিকটিকি, গিরগিটি মরে থাকতে দেখা যায়। এ ঘটনার কয়েক মাসের মধ্যেই এলাকাটি আবার সবুজে ভরে উঠেছিল।
এ ব্যাপারে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ছালেহ আহমদ বলেন, ‘আমাদের একটি দল সম্প্রতি যে অঞ্চলে ভবনগুলো করা হবে, সেখানে জরিপ চালিয়েছে। সেখানে অন্তত ৫০০ গাছ কাটা পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেখানকার শালগাছগুলোকে বাঁচানো উচিত।’
এদিকে গাছ কাটা হলে ওই এলাকার প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন বলেন, সেখানে প্রচুর পরিমাণে গুইসাপ, কাঠবিড়ালি, শিয়ালসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আছে। গাছগুলো কাটা হলে এসব প্রাণী হুমকির মুখে পড়বে।
গাছ কেটে যেভাবে উন্নয়ন
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকার অনুমোদন দেয় একনেক। এর মাধ্যমে ২২টি অবকাঠামো ও একটি সার্কুলার রোড নির্মাণকাজ রয়েছে। প্রকল্পের প্রথম ধাপের ৬টি আবাসিক হল নির্মাণ শেষ। দ্বিতীয় ধাপের কাজ এখন চলছে।
প্রথম ধাপে ছেলে ও মেয়েদের তিনটি করে মোট ছয়টি আবাসিক হল নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। ওই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের পাশে ছেলেদের জন্য তিনটি হল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। আপত্তি থাকার পরও ওই বছরের ২৩ আগস্ট সেখানকার অর্ধশতাধিক গাছ কেটে ফেলে প্রশাসন। এ সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বাধা দিলে গাছ কাটা বন্ধ হয়। পরে হল তিনটি শহীদ রফিক-জব্বার হলের পাশে নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। মেয়েদের তিনটি হল নির্মাণ করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির ২০৭টি গাছ কাটা পড়ে।
এদিকে গত বছরের দ্বিতীয় ধাপে ১৪ স্থাপনার নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন উপাচার্য অধ্যাপক নুরুল আলম। এতে মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে ছয় তলাবিশিষ্ট স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য শতাধিক গাছ কাটে প্রশাসন। একই সময় সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ভবনের পেছনে এক্সটেনশন ভবনের জন্য ২০০টি গাছ কাটা পড়ে।
মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের দাবি
গাছ কেটে ভবন নির্মাণ বন্ধ করা এবং চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নসহ অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে অবকাঠামো নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের নেতাকর্মীরা। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরেই মানববন্ধন, সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল ও স্মারকলিপি দিয়ে প্রতিবাদ করছেন। সম্প্রতি এই আন্দোলন আরও গতি পেয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সৌমিক বাগচী বলেন, উন্নয়নের নামে অনেক গাছ কাটা হয়েছে। মহাপরিকল্পনা ছাড়া কোনো অপরিকল্পিত ভবন এখন থেকে আমরা আর মেনে নেব না। একটি টেকসই ক্যাম্পাস গড়ে তোলার জন্যই আমাদের এই আন্দোলন।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘আমাদের আগে একটা মাস্টারপ্ল্যান দরকার। প্রকল্পের শুরুতেই আমরা মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কথা বলেছিলাম। তবে তা হয়নি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নুরুল আলম বলেন, ‘আমরা মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের বিষয়ে ভাবছি। এরই মধ্যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের সঙ্গে প্রাথমিক আলাপ করেছি। আশা করছি, একটা ভালো সমাধান আসবে।’
মন্তব্য করুন