- সারাদেশ
- কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় শিশুমৃত্যুর দায় কার?
কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় শিশুমৃত্যুর দায় কার?

জাহিন, জায়ান ও তাদের বোন। ছবি: সংগৃহীত
রোগব্যাধিতে নয়, আমাদের শিশুরা মারা যাচ্ছে– অবহেলা, অজ্ঞতা আর অবজ্ঞায়। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এক বাসায় তেলাপোক-ছারপোকা মারার ওষুধের বিষক্রিয়ায় স্কুলপড়ুয়া দুই সহোদরের মৃত্যু হয়েছে। এমন মৃত্যুকে কেবল করুণ বা মর্মান্তিক হিসেবে চিহ্নিত করলেই আমাদের দায় শেষ হয় না।
জানা যায়, মৃত দুই শিশু জাহিন-জায়ানের বাবা মোবারক তাঁর বাসায় তেলাপোকা-ছারপোকা মারার জন্য ডিসিএস অর্গানাইজেশন লিমিটেড নামে এক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া করেন। গত শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ওই কোম্পানির কর্মীরা মোবারকের বাসায় কীটনাশক প্রয়োগ করেন। এ সময় তিনি মাস্ক পরে তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা তখন বাইরে অবস্থান করছিলেন। কীটনাশক প্রয়োগ শেষে তাদের দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর ঘরে প্রবেশ করতে বলেন কোম্পানির কর্মীরা। তবে পরিবারের সদস্যরা অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করে প্রায় ১০ ঘণ্টা পরে বাড়িতে প্রবেশ করেন। এরপর পরিবারের সবাই রাতে এসি অন করে ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মোবারকের স্ত্রী, দুই ছেলে ও মেয়ে হঠাৎ বমি করতে শুরু করেন। পরে বিষয়টি পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিসকে জানালে তারা জানায়, এ ধরনের সার্ভিস নেওয়ার পর সাধারণত অ্যালার্জিজনিত সমস্যা ছাড়া অন্য কোনো উপসর্গ দেখা যাওয়ার কথা নয়। এরপর জাহিন-জায়ানের বাবা মোবারক পারিবারিক ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে বাসাতেই সে মোতাবেক ওষুধ খাওয়ান। কিন্তু পরের দিন ভোরে আবার একই সমস্যা দেখা দিলে পরিবারের সদস্যদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানেই মারা যায় ছোট ছেলে জায়ান। ছোট ছেলেকে দাফন করে আসতে না আসতেই মারা যায় বড় ছেলে জাহিন।
নতুন বাড়িতে উঠে তার অল্প কিছুদিন পরই চিরতরে ঘর ছেড়ে যাওয়ার ঘটনায় এই পরিবারের বাকি সদস্যদের সামনে আর কোনো সান্ত্বনা রইল কী? ঘরের পোকা দূর করার জন্য যে ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটি কতটা বিপজ্জনক কিংবা কতটা নিরাপদ– এমন প্রশ্ন এখন স্বাভাবিকভাবেই সামনে এসেছে।
শিশুদের বাবা টিস্যুতে রাখা ট্যাবলেটের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা শুনে সেটিকে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট বলে ধারণা করছেন কীটতত্ত্ব বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা। ওই আবাসিক বাসায় পোকা মারতে যে ট্যাবলেট ব্যবহার করা হয়েছিল এ ধরনের ট্যাবলেট সাধারণত খাদ্যগুদামে পোকামাকড় নিধনে ব্যবহার করা হয়। এক টন খাদ্যের বিপরীতে পাঁচ থেকে সাতটি ট্যাবলেট কাপড়ে বা টিস্যুতে মুড়িয়ে ব্যবহার করা হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এখন যে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা, তাতে গুদামে ট্যাবলেট ব্যবহারের পর অন্তত তিন দিন পর্যন্ত সেই ঘরে প্রবেশ করা নিষেধ। ট্যাবলেটগুলো পরে ফেলে দেওয়ার সময় নাক-মুখ ও কান ঢেকে, চোখে গ্লাভস ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বসুন্ধরার ওই বাসায় এই ধরনের ট্যাবলেট ব্যবহার করা হয়েছিল বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিপদের কথা হচ্ছে– এই ধরনের ট্যাবলেট ব্যবহারের জন্য কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি প্রতিষ্ঠানটি।
এই ধরনের ট্যাবলেট থেকে বের হওয়া গ্যাস নাক, কান ও চোখের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে। এই ধরনের ট্যাবলেট বিষাক্ত হওয়ায় বাসায় ব্যবহার একেবারেই নিষিদ্ধ। এটা যদি ওই বাসায় প্রয়োগ করা হয়ে থাকে তবে তা আইনবিরুদ্ধ।
আইনবিরুদ্ধ কাজ যেন এখানে নৈমত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরাধীরা অন্যায় করে দ্রুত পার পেয়ে যাওয়া এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গড়িমসির জন্য এই ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটেই চলেছে। শিশু জাহিন-জায়ানের পরিবার এই সময়ে যে অবর্ণনীয় শোক ও বেদনার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছে– আমরা কি তা অনুমান করতে পারি? এই দুই শিশুর মৃত্যুর জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করতে পারব কি আমরা? অন্তত এই দুই শিশুর মৃত্যু যা আসলে কাঠামোগত হত্যার শামিল, তার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
মন্তব্য করুন