- সারাদেশ
- বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে
সাক্ষাৎকার: ড. ফয়সাল কাদের
বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সফল তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায়ী ড. ফয়সাল কাদের । গড়ে তুলেছেন বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান– টেকনাফ, এলএলসি। বাঙালি কমিউনিটিতে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই মানুষটি একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিল্পীও বটে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের ওয়াশিংটন ডিসি প্রতিনিধি শাহিদ মোবাশ্বের
সমকাল: অভিবাসী হিসেবে আপনার শুরুটা কেমন ছিল?
ফয়সাল কাদের: স্টুডেন্ট হিসেবে এ দেশে আসার পর আমার কাছে সবকিছুই নতুন ছিল। আমার বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। তাঁর পক্ষে আমেরিকার এই উচ্চ টিউশন পরিশোধ করা সম্ভব ছিল না। তাই স্কুলের উচ্চ ফি’র কারণে আমাকে অনেক বেশি সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমি তিন-চারটি চাকরি করে রাত ১২টায় ঘরে ফিরেছি। দুই ঘণ্টা পড়ে আবার পরদিন সকাল ৮টায় ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিয়েছি। সেই সঙ্গে কিছু ঋণ নিয়ে এবং আমার দু’বোনের সহায়তায় পড়াশোনাটা শেষ করেছি। আমার স্ত্রী ও আমি একত্রে পরিশ্রম করেছি।
সমকাল: কর্মজীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে কিছু বলুন।
ফয়সাল কাদের: যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা আইটি কোম্পানি লকহিড মার্টিন দিয়েই আমার কর্মজীবন শুরু। ওখানে কয়েক বছর কাজ করার পর আমি আরেক বিশাল কোম্পানি জেনারেল ইলেকট্রিকে (জিই) যোগদান করি। ওখানে আমি ১০-১১ বছর কাজ করেছি। সেখানে আমরা এয়ারক্রাফট অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করতাম। ২০০২ সালে যখন আউটসোর্সিং সবে শুরু হচ্ছিল, তখন জিই আমাদের পাঁচজনকে দক্ষিণ ভারতের বেঙ্গালুরুতে পাঠায়। কিছুটা সাংস্কৃতিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় একটি পাইলট প্রজেক্টে টিম লিডের দায়িত্ব দিয়ে ভিন্ন পরিবেশ আর মানসিকতার একটি দেশে আউটসোর্সিং কাজ করে কিনা, সেটা যাচাই করতে অন্য চারজন আমেরিকানের সঙ্গে আমাকে পাঠানো হয়। ওখানে গিয়ে আইআইটির ২০ সেরা প্রকৌশলী নিয়োগ করি। এর পর ছয় মাসে আমরা প্রথম রিলিজ, ৯ মাসে দ্বিতীয় রিলিজ এবং ১২ মাসে অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপ করে পুরো প্রডাক্ট করে দিলাম। এতে জিইর ম্যানেজমেন্ট এবং সিইও আমাদের ওপর খুশি হয়ে গেলেন। ইতোমধ্যে আমি আমার কোম্পানি বড় করলাম। এখন আমার কোম্পানিতে দেড়শ জনের মতো কাজ করেন এবং বাংলাদেশেও টেকনাফ লিমিটেড নামে আমার এই কোম্পানির একটা শাখা আছে। ওখানে ৩০-৩৫ জনের মতো কাজ করছেন। বাংলাদেশে একজনকে চাকরি দেওয়ার অর্থ হচ্ছে– ১০ সদস্যের একটি পরিবারের ভালোভাবে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা। তাই এটি একটা বড় সন্তুষ্টি।
সমকাল: আপনি তো বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করছেন।
ফয়সাল কাদের: জিইতে কাজ করার সময় পার্টটাইম মাস্টার্সও করতাম। ইনফরমেশন সিস্টেম, ডাটা সায়েন্স অ্যান্ড সাইবার সিকিউরিটির ওপর পিএইচডি করতে বেশ সময় লাগলেও তা শেষ করলাম। এর পর ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড থেকে শিক্ষকতার একটা প্রস্তাব এলো। আমি সেখানে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মেশিন লার্নিং এবং সাইবার সিকিউরিটির ওপর পড়াচ্ছি।
সমকাল: আপনারা মূলত কোথায় কোথায় কাজ করেন?
ফয়সাল কাদের: আমাদের কোম্পানি টেকনাফ, এলএলসি মূলত কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টার্নাল রেভিনিউ সার্ভিসে (আইআরএস), যে প্রতিষ্ঠানে আমেরিকান ট্যাক্সপেয়াররা ট্যাক্স ফাইল করে। এ প্রতিষ্ঠান এত বড় যে, তাদের বার্ষিক রেভিনিউ ৩ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। সারাবিশ্বের ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে যে, যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক রাজস্ব সর্বোচ্চ। আমরা ১৩ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করছি। কোনো কাজ করতে চলতি বছর থেকে পরবর্তী বছরে কত টাকা লাগবে, তার পরের বছরে কত টাকা লাগবে–এটা কিন্তু বৈজ্ঞানিক উপায়ে না করলে গোলমাল হয় এবং আমেরিকান সরকারের বিপুল অর্থ গচ্চা যায়। আমরা এখানে বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রাইস প্রেডিক্ট করছি। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্সেও (ডিওডি) কাজ করি। সেখানে আমরা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং, সাইবার সিকিউরিটি, সিকিউরিটি সফট ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, প্রডাক্ট ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি বিষয়ে কাজ করি।
সমকাল: আপনি বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য কিছু করছেন কি?
ফয়সাল কাদের: আমি বিভিন্ন কমিউনিটি ওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত। আমাদের একটি অর্গানাইজেশন আছে, যার নাম আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড আর্কিটেক্ট বা আবিয়া। আমি এর প্রেসিডেন্ট ছিলাম। বিভিন্ন স্টেটে আমাদের বেশ কয়েকটি চ্যাপ্টার আছে। আমরা বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও সেমিনার করি এবং টেকনিক্যাল বিষয়ে আলোচনা করি। আমরা শিশুদের বৃত্তি দিই এবং যারা ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে চাকরি খুঁজছে, তাদের চাকরির ব্যবস্থা করে থাকি। আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আর্থিক সহায়তাও দিই। আমাদের আরও একটি অর্গানাইজেশন আছে, যার নাম বাংলাদেশি এন্টারপ্রেনিয়ার্স সোসাইটি অব ট্যালেন্টস-বেস্ট। সেটা হলো, আমরা বাংলাদেশি অরিজিন উদ্যোক্তাদের একই ব্যানারে আমেরিকার মূলধারায় আনার চেষ্টা করছি।
সমকাল: আপনার সফলতার পেছনের শক্তি কী?
ফয়সাল কাদের: আমি শিক্ষাজীবন থেকেই অনেক পরিশ্রম করেছি। এ কারণে আমি আমার পরিবারকে সময় দিতে পারিনি। কিন্তু আমার স্ত্রীর সাপোর্ট ছাড়া হয়তো এতদূর আসতে পারতাম না। আরও একটি বিষয় সামনে আনতে চাই। আর তা হচ্ছে আমার গান। অত্যন্ত পরিশ্রমের পর গান গেয়ে বা শুনে আমার ক্লান্তি দূর করি।
সমকাল: আপনি কি মনে করেন, আপনার সব স্বপ্ন পূরণ হয়েছে?
ফয়সাল কাদের: দেখুন, যে কোনো সফলতার জন্য একটা স্বপ্ন থাকতে হয়। সেই সঙ্গে বড় চিন্তাও। আমি সব সময় বড় চিন্তা করেছি এবং সেই জন্য চেষ্টাও। যেটা আমি সবাইকে বলি– সফলতার কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই। এটি পেতে হলে ছোট ছোট পদক্ষেপ নিয়েই এগোতে হবে। আর কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প নেই। কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি দৃঢ়তা নিয়ে এগোলে সফলতা আসবেই। এই যে আমি যতটুকু এসেছি বা সফল হয়েছি, এখনও মনে হয় আমি আরও বেশি কীভাবে সফল হতে পারি, কীভাবে একজন সফল পেশাজীবী হয়ে উঠতে পারি, কীভাবে কমিউনিটিকে সাহায্য করতে পারি, কীভাবে প্রত্যেককে সুখী করতে পারি; সে চিন্তা থেকেই এগিয়ে যাই প্রতিনিয়ত। সর্বোপরি বলতে পারি– আমার যেসব স্বপ্ন ছিল, তার প্রায় সবই পূর্ণ হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ!
সমকাল: কমিউনিটির লোকজনের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
ফয়সাল কাদের: আমরা কমিউনিটির লোকজন একত্রে কাজ করতে পারলে অনেক ভালো কিছু করতে পারতাম। আমাদের সংস্কৃতি অনেক বেশি সমৃদ্ধ। এ সংস্কৃতিকে আমরা আরও বেশি করে তুলে ধরতে একত্রে কাজ করতে পারি। মতাদর্শ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু কমিউনিটির প্রশ্নে ব্যক্তিস্বার্থকে পেছনে ফেলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে– এটাই আমার প্রত্যাশা।
সমকাল: আগামীর বাংলাদেশকে আপনি কীভাবে দেখতে চান?
ফয়সাল কাদের: বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নে আমি ভীষণ খুশি। এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা পূরণ করতে হবে। আমাদের হাতে আছে আর মাত্র ১৮ বছর। এই ১৮ বছরকে ১৫ বছরে নামিয়ে আনতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রবাসে বসবাসকারী সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। এই যে আমেরিকান কোম্পানিতে হাজার হাজার ভারতীয় কাজ করে, সে অনুপাতে বাংলাদেশিরা কাজ করছে না। আরও বেশিসংখ্যক বাংলাদেশিকে সম্পৃক্ত করতে হবে। যে বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি– দুর্নীতি কমিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সেবা খাতসহ সর্বক্ষেত্রে ই-গভর্ন্যান্স চালু হলে দুর্নীতিও কমে যাবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
সমকাল: আপনার সাফল্যে কমিউনিটির অনেকেই খুশি। তাঁদের অনেকেই আপনাকে ভালোবেসে ‘বাংলা গেটস’ বলে ডাকে। এতে আপনার কেমন লাগে?
ফয়সাল কাদের: এটা আমার সৌভাগ্য যে, কমিউনিটির সবাই আমাকে ভালোবাসে, সম্মান করে। যদিও আমি এতটা সম্মান পাওয়ার যোগ্য নই। তারপরও কমিউনিটির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতা করে আমি তাঁদের সম্মানের মর্যাদা দিতে চাই। আর ‘বাংলা গেটস’ বা সংক্ষেপে বিজি বলে অনেকেই আমাকে সম্বোধন করলে খারাপ লাগে না। তবে যাঁর সঙ্গে মিল রেখে আমাকে ওই নামে ডাকা হয়, তাঁর সঙ্গে তুলনা করা একেবারেই বেমানান।
সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ।
ফয়সাল কাদের: সমকালকেও ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন