- সারাদেশ
- চোরাই পথে ভারত থেকে আসছে চিনি
চোরাই পথে ভারত থেকে আসছে চিনি

ফাইল ফটো
ভারত থেকে অবৈধ পথে আনা চিনি দখল করে নিচ্ছে ময়মনসিংহ অঞ্চলের বাজার। বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে দাম কম থাকায় সুযোগ নিচ্ছে চোরাকারবারিরা। সীমান্তের চার উপজেলা দিয়ে চোরাচালান হচ্ছে। এতে দেশি ও আমদানি করা চিনির বিক্রি কমে গেছে।
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, নেত্রকোনার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলার সীমান্ত দিয়ে আনা হচ্ছে ভারতীয় চিনি। সীমান্ত দিয়ে বাইসাইকেল ও মোটরসাইকেলে এসব আনা হয়। পরে পিকআপ ভ্যানে ছড়িয়ে দেওয়া হয় দেশের বাজারে। চিনির ৫০ কেজির বস্তা আনায় খরচ প্রায় ৩ হাজার ৮০০ টাকা। কয়েক হাত বদল হয়ে এসব চলে যায় বিভিন্ন প্রান্তে। সীমান্ত পার করার পর ভারতীয় বস্তা পরিবর্তন করে বাজারজাত করা হয়। পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে প্রতি বস্তা ৫ হাজার ৭০০ থেকে ৫ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। বাজারে আমদানি করা চিনির ৫০ কেজি বস্তার দাম ৬ হাজার ১৪০ থেকে ৬ হাজার ২৫০ টাকা। চোরাচালানের চিনি খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হয় বৈধভাবে আনা চিনির দামেই। তাই একশ্রেণির পাইকারি ব্যবসায়ী অধিক লাভের আশায় চোরাচালানের চিনি বিক্রিতে ঝুঁকছেন।
ময়মনসিংহ নগরীর পাইকারি বিক্রেতা প্রদীপ চন্দ্র ঘোষ সমকালকে বলেন, দেশবন্ধু চিনি ৫০ কেজির বস্তা ৬ হাজার ১৪০ টাকা ও ফ্রেশ ও তীর কোম্পানির চিনি ৬ হাজার ২৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু গত তিন মাস ধরে ভারতীয় চিনি আসায় তাদের বিক্রি কমেছে। আগে সপ্তাহে অন্তত ১ হাজার ২০০ বস্তা বিক্রি করা যেত। এখন ৪০০ বস্তাও বিক্রি করা যায় না। একই রকম অবস্থা অন্য ব্যবসায়ীদেরও। দামে কম পাওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী ভারতীয় চিনি কিনছেন। কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, কম দামে পাওয়ায় তাঁরা কিছু লাভের আশায় ভারতীয় চিনি বিক্রি করেন। চিনির সরবরাহ অপ্রতুল থাকায় তাঁরা বাধ্য হন এসব কেনাবেচা করতেন।
পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) গত মে মাসে অভিযান চালিয়ে ১৪৯ বস্তা চিনি জব্দ করেছে। গ্রেপ্তার করা হয় ৯ চোরাকারবারিকে। গত ৩ জুন র্যাব ৫০ বস্তা চিনিসহ একজনকে আটক করেছে। এদিন বিকেলে ফুলপুর উপজেলার বওলা এলাকায় র্যাবের একটি দল পিকআপ ভ্যানে তল্লাশি চালিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ধোবাউড়া সীমান্ত দিয়ে আনা চিনি পায়। ২ হাজার ৫০০ কেজি চিনিসহ সুমন শেখ নামে এক তরুণকে আটক করা হয়। সুমন পিকআপটির চালক। বেশি ভাড়ার আশায় পাচারকারী চক্রের চিনি পরিবহন করছিল বলে জানায়। অভিযানের সময় মূল হোতাকে পাওয়া যায়নি। র্যাব জানায়, চক্রটি চোরাই পথে বিদেশি পণ্য এনে বিক্রি করে। সুমনকে ফুলপুর থানায় হস্তান্তর করা হয়।
গত ৩১ মে মধ্য রাতে ময়মনসিংহের চায়নামোড় এলাকা থেকে পিকআপ ভ্যানভর্তি ভারতীয় চিনি জব্দ করে পুলিশ। ৪৫ বস্তা চিনিসহ গ্রেপ্তার করা হয় তিনজনকে। তারা হলো মাহফুজুল হক মাসুম, মোফাজ্জল হোসেন ও মো. হারুন। তারা ফুলবাড়িয়া উপজেলার বাসিন্দা। গত ২৭ মে হালুয়াঘাট উপজেলার ধারাবাজার থেকে ৫০ বস্তা চিনি জব্দ করে পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় কামরুজ্জামান খান বাবুল ও মো. আনোয়ার হোসেনকে। তারা হালুয়াঘাটের দর্শাপাড়া এলাকার বাসিন্দা। গত ২৫ মে ধোবাউড়া থানাধীন ঘোষগাঁও থেকে ২৪ বস্তা চিনি জব্দ ও সমর আলী নামে একজনকে গ্রেপ্তার কার হয়। ২১ মে ধোবাউড়ার গোয়াতলা বন্দর থেকে ৩০ বস্তা চিনি জব্দ করা হয়।
গ্রেপ্তার করা হয় সাফায়েত হোসেন, আসাদুল ব্যাপারী ও রাসেল মিয়াকে। সাফায়েত ধোবাউড়া উপজেলা সদর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। অন্য দু’জন ছাত্রলীগের কর্মী। গত ১৫ এপ্রিল দুর্গাপুর উপজেলার ফেঁচিয়া গ্রাম থেকে ২৮ বস্তা চিনিসহ চারজনকে স্থানীয়রা আটক করলে পুলিশ চিনি জব্দ করে। গত ২৭ এপ্রিল নেত্রকোনার বারহাট্টায় ১০ হাজার ১০০ কেজি চিনিসহ চারজনকে আটক করে পুলিশ। এ সময় চোরাচালানে ব্যবহৃত দুটি পিকআপ ও একটি ইজিবাইক জব্দ করা হয়। গত ১৭ এপ্রিল কলমাকান্দা উপজেলায় ৯০ বস্তা চিনিসহ দু’জনকে আটক করে পুলিশ। চান্দুয়াইল এলাকা থেকে চিনিভর্তি দুটি পিকআপ ভ্যানসহ তাদের আটক করা হয়। অবৈধ পথে আনা চিনি পিকআপ ভ্যানে করে নেত্রকোনা শহরে নেওয়া হচ্ছিল।
কলমাকান্দা প্রতিনিধি শেখ শামীম জানান, কলমাকান্দা সীমান্ত দিয়ে দিনরাতে অবাধে আসছে শতশত বস্তা চিনি। সীমান্ত পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিনব কায়দায় দেশীয় বিভিন্ন কোম্পানির বস্তায় ওই চিনি ভরা হয়। মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিছু পরিমাণ জব্দ করলেও চোরাকারবারিরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সীমান্ত এলাকার লোকজন বলছেন– চিনির সঙ্গে চোরাকারবারিরা আনছে ভারতীয় মাদকদ্রব্য।
লেংগুরা ইউনিয়নের কাঁঠালবাড়ি, জগন্নাথপুর, সাতশহীদের মাজার, কালাপানি, তকলেটবাড়ি, খারনৈ ইউনিয়নের বৌবাজার, বলমাঠ, কচুগড়া ও রংছাতি ইউনিয়নের পাতলাবন, পাঁচগাঁও, জাকিরপাড়া, নক্লাই, রামনাথপুর দিয়ে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার চিনিসহ বিভিন্ন পণ্য আনা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ভারত থেকে প্রতিদিন প্রায় ১২শ বস্তা চিনি বিভিন্ন এলাকা দিয়ে কলমাকান্দায় ঢুকছে। বরুয়াকোনার ব্যবসায়ী ইনসা বলেন, ভারতের সীমান্ত বাজার থেকে স্থানীয়দের সহযোগিতায় চিনি নিয়ে আসেন। পরে স্থানীয় মহাজনের কাছে বিক্রি করেন। স্থানীয় মহাজন কাঁচাধন বলেন, সব কিছু ম্যানেজ করেই ব্যবসা পরিচালনা করেন তাঁরা।
ব্যবসায়ীদের সংগঠন ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি শংকর সাহা বলেন, দেশের চিনিকলগুলো স্বাবলম্বী হলে ভারতীয় চিনি আসত না। দেশের চিনিকলগুলোর সক্ষমতা খুবই কম। সীমান্তে যারা দায়িত্বে থাকেন তাদের নজরদারিও বাড়াতে হবে। ভারতীয় চিনি দেশে আসায় সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
র্যাব-১৪ ময়মনসিংহের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, অধিক লাভের আশায় ভারতীয় চিনি চোরাচালানের মাধ্যমে আনা হচ্ছে। এসব তৎপরতা রোধে তাঁরা কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
ময়মনসিংহের গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, দামের ব্যবধানের কারণে ভারতের চিনি আসছে। সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সংঘবদ্ধ চক্র চোরাচালান করছে। বিষয়টি নিয়ে তাঁরা তৎপর আছেন।
ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, ‘চোরাচালানের বিষয়ে পুলিশ সংবাদ পেলে আটক করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। চোরাচালান প্রতিরোধের জন্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) আছে, তারা আটকাবে। তারপরও যদি দেশে প্রবেশ করে,অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’
এ প্রসঙ্গে বিজিবি ময়মনসিংহের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমাদের চোখের আড়াল দিয়ে যদি কিছু চলে আসে তা ধরা অসম্ভব। তবে সীমান্তে টহলের কোনো রকম ঘাটতি নেই। সৈনিকরা দিনরাত পরিশ্রম করছেন। বিজিবির দায়িত্বপূর্ণ এলাকা হচ্ছে সীমান্ত থেকে ৮ কিলোমিটার। চোরাচালানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিলে সে অনুযায়ী কাজ করা হবে।’
মন্তব্য করুন