- সারাদেশ
- কর্মসৃজন প্রকল্পে লুটপাট
কর্মসৃজন প্রকল্পে লুটপাট
নালিতাবাড়ীতে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প এলাকায় কম শ্রমিকের উপস্থিতি, হাজিরা খাতা ও সাইনবোর্ড না থাকা, শ্রমিকদের তালিকায় ইউপির উদ্যোক্তা, চৌকিদার, ইউপি সদস্যের স্বজনদের অন্তর্ভুক্তি, শ্রমিকদের সিমকার্ড ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যের পকেটে রাখার মতো অনিয়মে চলছে এই প্রকল্পের কাজ।
জানা গেছে, নালিতাবাড়ী উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে ১০ এপ্রিল থেকে ৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। এ পর্যায়ে ৪৬টি প্রকল্পে দুই হাজার শ্রমিকের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ২ কোটি ৮৮ লাখ ৯২ হাজার টাকা। প্রত্যেক শ্রমিকের দৈনিক ৪০০ টাকা মজুরি এবং সর্দার ভাতা দুই হাজার টাকা। এর মধ্যে পোড়াগাঁও ইউনিয়নে তিনটি প্রকল্পে ২২ লাখ ৫২ হাজার ৪০০ টাকা, নন্নী ইউনিয়নে তিনটি প্রকল্পে ২২ লাখ ২৩ হাজার ৬০০, রাজনগর ইউনিয়নে পাঁচটি প্রকল্পে ২৭ লাখ ২ হাজার ৮০০, নয়াবিল ইউনিয়নে চারটি প্রকল্পে ২৩ লাখ ৯৮ হাজার ৪০০, রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নে চারটি প্রকল্পে ২২ লাখ ৫৪ হাজার ৪০০, কাকরকান্দি ইউনিয়নে তিনটি প্রকল্পে ২১ লাখ ৮০ হাজার ৪০০, নালিতাবাড়ী ইউনিয়নে তিনটি প্রকল্পে ১৯ লাখ ২১ হাজার ২০০, রূপনারায়ণকুড়া ইউনিয়নে তিনটি প্রকল্পে ১৯ লাখ ৫০ হাজার, মরিচপুরান ইউনিয়নে পাঁচটি প্রকল্পে ২৩ লাখ ৪২ হাজার ৮০০, যোগানিয়া ইউনিয়নে পাঁচটি প্রকল্পে ২৬ লাখ ৮৮ হাজার ৪০০, বাঘবেড় ইউনিয়নে চারটি প্রকল্পে ২৫ লাখ ২৮ হাজার এবং কলসপাড় ইউনিয়নে চারটি প্রকল্পে ৩৪ লাখ ৪৯ হাজার ৬০০ টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
রামচন্দ্রকুড়া, নালিতাবাড়ী, মরিচপুরান ও কাকরকান্দি ইউনিয়নের প্রকল্পগুলো ঘুরে দেখা গেছে, শ্রমিক উপস্থিতি ৬০ শতাংশের কম। এসব ইউনিয়নের বাসিন্দারা জানান, উন্নয়নের জন্য লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ এলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রকল্পের নামে চলছে লুটপাট।
রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের পানিহাটা মিশন রোড উঁচু লালমাটি থেকে যোগ সাংমার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার প্রকল্পে ৩০ শ্রমিকের জন্য বরাদ্দ ৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। এখানে কাজ করছেন ১৫ শ্রমিক। কর্মরত শ্রমিক হজরত আলী জানান, শুরু থেকেই ১৫ থেকে ১৯ জন শ্রমিক কাজ করছেন। তদারকি করতে আসেন না কেউ। একই ইউনিয়নের তন্তর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শামছুল হকের বাড়ি থেকে কান্দাপাড়া মসজিদ পর্যন্ত প্রকল্পে ৪২ শ্রমিকের জন্য বরাদ্দ ৬ লাখ ৬ হাজার ৮০০ টাকা। এখানে কাজ করছেন ১৬ থেকে ১৯ জন। এই ইউনিয়নের অন্য প্রকল্পগুলোর চিত্রও একই রকম। এই ইউনিয়নের প্রকল্পের শ্রমিকের তালিকায় ইউপির উদ্যোক্তা, চৌকিদার, প্যানেল চেয়ারম্যানের স্ত্রীসহ বেশ কিছু ভুয়া শ্রমিকের নাম রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইউপি সদস্য জানান, বরাদ্দের বড় একটি অংশ যায় প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসে। কাজেই এই প্রকল্পের দুর্নীতি ‘ওপেন সিক্রেট’।
গ্রামের এসব ছোটখাটো বিষয়ে খোঁজ না করে এই প্রতিবেদককে বড় বড় বিষয়ে লেখালেখির পরামর্শ দেন রামচন্দ্রকুড়া ইউপি চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম খোকা।
নালিতাবাড়ী ইউনিয়নে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৮০ শতাংশ শ্রমিকের বেতনের সিমকার্ড ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানের কাছে জমা রয়েছে। চলমান তিনটি প্রকল্পের কোনো সাইনবোর্ড নেই। শ্রমিকের তালিকায় রয়েছেন নারী ইউপি সদস্যের স্বামীর নাম। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান আসাদের ভাষ্য, শ্রমিকদের বেতনের সিমকার্ড তাঁদের কাছেই আছে। শ্রমিকদের তালিকায় নারী ইউপি সদস্যের স্বামীর নাম রয়েছে এবং তিনি কাজ করেন।
মরিচপুরান ইউনিয়নে প্রকল্পের শ্রমিক তালিকায় রয়েছে ইউপি সদস্যের ছেলে, বোন, চাচাতো ভাই, ছেলের বউ, চৌকিদারের ছেলের নাম। তাঁরা কোনোদিন কাজে যাননি বলে জানিয়েছেন কর্মরত শ্রমিকরা। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার বলেন, যাঁদের নাম আছে, তাঁরা কাজে যান। চৌকিদারের ছেলের নাম আছে, কাজ করেন চৌকিদার নিজে।
কাকরকান্দি ইউনিয়নে বেতনের অ্যাকাউন্ট করা হয়েছে একটি মোবাইলের দোকানে। বরাদ্দের টাকা জমা হলে সেই দোকান থেকে অনুপস্থিত শ্রমিকদের টাকা তুলে নেন সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্যরা।
কাকরকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান নিয়ামুল কাউসারের দাবি, সব শ্রমিকের বেতনের সিমকার্ডে একই পিন নম্বর দেওয়ায় একজনের টাকা অন্যজন তুলতে পারতেন এবং হ্যাক হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। যেমন– মায়ের নামে সিমকার্ডে দেখা গেছে, দোকান থেকে ওই সিমকার্ড নিয়ে টাকা তুলে নিয়েছে ছেলে। তাই শ্রমিকদের সুবিধার্থে নিজ নিজ এলাকাভিত্তিক বিকাশের দোকান থেকে নিজে টাকা তুলতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান বলেন, বিষয়টি জানা ছিল না। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন