নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের উপনির্বাচন আগামী সোমবার। এ ওয়ার্ডে অবস্থিত আলোচিত চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র। কারাবন্দি অবস্থায় গত ৩১ মার্চ মারা যান ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য বজলুর রহমান। তাঁর মৃত্যুতে সদস্যপদটি খালি হয়।

১২ জুনের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা ১৬ প্রার্থীর মধ্যে সাতজনের বিরুদ্ধেই নানা অভিযোগে মামলা রয়েছে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, শীতলক্ষ্যার তীরঘেঁষা চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র ঘিরে সক্রিয় নানা অপরাধী চক্র। ঢাকা ও আশপাশের এলাকার মাদক ও অস্ত্রের বড় চালানও এখান থেকে যায়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, টাকা দিলেই চনপাড়ায় ভাড়াটে হত্যাকারী ও সন্ত্রাসী পাওয়া যায়। যে কারণে কায়েতপাড়ার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্যপদটি গুরুত্বপূর্ণ। সদস্য নির্বাচিত হলে অবৈধ সব কারবারের ওপর নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পাঁচ বছরে অন্তত ৫০-৬০ কোটি টাকার মালিক হওয়ার হাতছানি থাকায় এ সদস্যপদ নিয়ে এত কাড়াকাড়ি।

আগামী নির্বাচনে সদস্যপদে লড়ছেন জয়নাল আবেদীন, শমসের আলী খান, শাহাবুদ্দিন, রবিন, খলিলুর রহমান, শফিকুল ইসলাম, আল-আমিন, আনোয়ার হোসেন, ইব্রাহিম মোল্লা, জহিরুল ইসলাম রাসেল, আবিদ হাসান, চান মিয়া, মো. ইব্রাহীম, জাহাঙ্গীর আলম, নূরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ বাবুল। তাঁদের সাতজনই বিভিন্ন মামলার আসামি।

রূপগঞ্জ থানা সূত্রে জানা গেছে, জয়নাল আবেদীনের (৩৯) বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা, মাদক, অস্ত্র, বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুরের অভিযোগে হওয়া মামলা রয়েছে। অপর প্রার্থী শমসের আলী খানের বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় অস্ত্র, মাদক, হত্যা, হামলা-ভাঙচুরসহ নানা অভিযোগে ১৩টি মামলা রয়েছে। শাহাবুদ্দিন মাদক ও অস্ত্র আইনের মামলাসহ ৭টি মামলার আসামি। শফিকুল ইসলাম ওরফে জাহিদের বিরুদ্ধেও মামলা রয়েছে ৭টি। এ ছাড়া খলিলুর রহমান ও আলামিনও একটি করে মামলার আসামি।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চনপাড়া বস্তি হিসেবে পরিচিত পুনর্বাসন কেন্দ্রে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সম্প্রতি কয়েক দফায় সংঘর্ষ হয়েছে জয়নাল ও শমসেরের নেতৃত্বাধীন দলের। তাঁদের দলের সঙ্গে আবার সংঘর্ষ হয়েছে শাহাবুদ্দিনের দলেরও।

ওই এলাকার বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। তবে নিরাপত্তার শঙ্কায় কেউই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তাঁরা জানিয়েছেন, অর্ধযুগ আগেও চনপাড়া বস্তির নিয়ন্ত্রণ ছিল কায়েতপাড়া ইউপির ৭, ৮, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত (মহিলা) ইউপি সদস্য বিউটি আক্তার কুট্টির হাতে। ২০১৯ সালের ২৬ জুন তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পরে এর নিয়ন্ত্রণ নেন ৯ নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন সদস্য বজলুর রহমান। তিনি বনে যান চনপাড়ার অঘোষিত ডন। ২০২২ সালের ১৮ নভেম্বর চনপাড়ায় র‍্যাব সদস্যদের ওপর হামলা হয়। এ ঘটনায় বজলুরকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। চলতি বছরের মার্চে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে ৩১ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।

এর পর থেকেই অন্তত অর্ধডজন দল-উপদল চনপাড়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। জয়নাল, শমসের, শাহাবুদ্দিন ছাড়াও ইয়াছমিন, রায়হানের নেতৃত্বাধীন দলও রয়েছে। এসব দলের নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিরাই ইউপি সদস্যপদে প্রার্থী হয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১১ এপ্রিল জয়নাল, শমসের ও শাহাবুদ্দিনের লোকদের মধ্যে রাতভর ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এতে তিনজন গুলিবিদ্ধসহ ২০ জন আহত হন। ৩০ এপ্রিল পুলিশ অভিযান চালিয়ে চনপাড়া থেকে ১৩ জনকে দেশীয় অস্ত্র, মাদকসহ গ্রেপ্তার করে। মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ১১ মে আবারও সংঘর্ষে জড়ায় জয়নাল, শমসের ও শাহাবুদ্দিনের লোকজন। এদিন একজন গুলিবিদ্ধসহ তিন পক্ষের ২৪ জন আহত হন।

এসব বিষয়ে সদস্য প্রার্থী জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘আমাকে ফাঁসানোর জন্য প্রতিপক্ষ অধিকাংশ মামলা করেছে। এলাকায় কোনো ঝামেলায় পুলিশ আসামি খুঁজে না পেলেও আমাকে অযথা আসামি করে।’ নিজেকে ব্যবসায়ী দাবি করে বলেন, সব দিক ম্যানেজ করে চলতে হয়। এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। একই রকম বক্তব্য দেন শম‌সের আলী খানও।

রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সায়েদ বলেন, উপনির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক বিশেষ সভা হয়েছে। এতে আইন ভঙ্গ না করতে অপরাধীদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।

২১ মে বিকেলে চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র এলাকায় আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক ওই বিশেষ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন জেলা প্রশাসন মঞ্জুরুল হাফিজ। তিনি বলেন, ‘ভোট নিয়ে ভয়ভীতি দেখানো বা জোরাজুরি করা হলে জেলখানায় দেখা হবে। ৫০ থেকে ১০০ জন মানুষের আচরণের কারণে চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র এলাকার এত বদনাম। অনেক মাদকসম্রাট-সম্রাজ্ঞীর নাম শুনেছি। ছবিসহ আমাদের কাছে তাদের তালিকা রয়েছে। কারা কী করছে রেকর্ড নিচ্ছি।’