‘আর্সেনিকের কারণে আমাদের গ্রামে দুইজন মারা গেছে। আমি ডান হাতের তিনটি আঙুল হারিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হবে। এ হাত নিয়েও কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছি। সরকার কিংবা কোনো এনজিও কখনও খোঁজ নিতে আসে না।’

 কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার মিয়াপুর গ্রামের বাসিন্দা আর্সেনিক রোগী মোহাম্মদ রাব্বানী।

একই অভিযোগ পাশের হলপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাকের। তিনি বলেন, প্রতি মাসে তাঁর ৪০০-৫০০ টাকার ওষুধ লাগে। নয়তো কোনো কাজ করতে পারেন না। তাঁর মতো অনেকেই আর্সেনিক আক্রান্ত আছেন। তাঁদের খোঁজ কেউ নেয় না। পরিবারের লোকজনকে সাবধানে রাখতে চান; কিন্তু নলকূপের আর্সেনিক পরীক্ষা করাতে পারেন না।

শুধু রাব্বানী কিংবা রাজ্জাক নন, উপজেলার আর্সেনিকের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা মিয়াপুর, মাঠপাড়া, তালবাড়িয়া, নিমপাড়া ও রায়পুর এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ একই। শরীরে আর্সেনিকের উপসর্গ দেখা দেওয়ায় নানা ধরনের সমস্যায় ভুগছে এখানকার মানুষ। শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুটিগুটি ক্ষত সৃষ্টি হওয়ায় রোদে গিয়ে পরিশ্রম করতে পারেন না তাঁরা। এসব এলাকার মানুষ আর্সেনিকের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকলেও উপজেলার কোনো দপ্তরের কাছে আক্রান্তদের পরিসংখ্যান নেই।

গত এক সপ্তাহ সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলো ঘুরে আর্সেনিকের লক্ষণযুক্ত রোগীর দেখা পাওয়া গেছে। দীর্ঘ বছর ধরে ব্যাধি বয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁরা। এমনকি আর্সেনিক প্রতিরোধে সরকারি কোনো কার্যক্রম আছে কিনা সেটাও জানেন না তাঁরা।

তবে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে, আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসনে চলমান ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ১৫ লাখ টাকা ব্যয় করে ১৫ হাজার নলকূপের আর্সেনিক পরীক্ষা করেছে তারা।

তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও এনজিও ফোরাম পাবলিক হেলথ কর্তৃপক্ষ ‘পানি সরবরাহে আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসন প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পের আওতায় উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের প্রতিটিতে ২ হাজার ৫০০ করে মোট ১৫ হাজার নলকূপের আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার পর ১৪০টি নলকূপের পানিতে ৫০ পিপিবির (পার্টস পার বিলিয়ন) বেশি মাত্রায় আর্সেনিক শনাক্ত হয়েছে। সেগুলো লাল রং করে দেওয়া হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সব ইউনিয়নে আর্সেনিক পরীক্ষা হয়েছে বললেও বাস্তবে তা পাওয়া যায়নি। আবার আর্সেনিক টেস্টার নিয়োগের ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

আর্সেনিক টেস্টারদের তালিকা যাচাই করে দেখা যায়, উপজেলার ইউসুফ ইউনিয়নে যে ছয়জন আর্সেনিক পরীক্ষার জন্য নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁরা সবাই বাদুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা। নিমপাড়া ইউনিয়নে শাকিল রহমান নামে এক ব্যক্তি আর্সেনিক টেস্টার হিসেবে নিয়োগ পেলেও বাস্তবে তাঁর বদলে কাজ করছেন অন্যজন। শাকিল দেড় বছর ধরে ঢাকায় চাকরি করছেন। আর্সেনিক টেস্টারদের নামের তালিকা সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান পাঠিয়েছেন বলা হলেও বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানরা এ প্রকল্পের ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানান।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে আর্সেনিক পরীক্ষার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। নলকূপগুলোতে লাল কিংবা সবুজ রঙের কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি।

ভায়ালক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের আর্সেনিক টেস্টার মামুনুর রশীদ ও ইউসুফপুর ইউনিয়নের আবু শিমুল বলেন, দু’জন নিয়ে গঠিত একটি দলের দায়িত্বে ইউনিয়নের তিনটি করে ওয়ার্ড ছিল। কিন্তু তাঁরা মাত্র একটি করে ওয়ার্ডের নলকূপ পরীক্ষা করতেই তাঁদের টার্গেট পূরণ হয়ে গেছে। এ জন্য সব জায়গার নলকূপের আর্সেনিক পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

আর্সেনিক পরীক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলার ইউসুফপুর ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম মাখন বলেন, তিনি দেড় বছর ধরে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু তাঁর ইউনিয়নে কখনও আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়েছে বলে শোনেননি। এরকম কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি।

আর্সেনিক প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে স্থানীয় নাগরিক কমিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর নামমাত্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। আর্সেনিকের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে এ প্রকল্পের কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। আর্সেনিক পরীক্ষার পাশাপাশি আক্রান্তদের তালিকা করে তাঁদের চিকিৎসা নিশ্চিতের দাবি জানান তিনি।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, প্রকল্প ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাস্তবায়ন হলেও টেস্টারদের তালিকা নেওয়া হয়েছে আগের চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে। প্রকল্পে কোনো অনিয়ম হয়নি। তবে উপজেলায় কতজন আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী আছে, সে ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি। গত বুধবার আর্সেনিক প্রকল্পে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএনও সোহরাব হোসেন বলেন, এরকম কোনো প্রকল্প উপজেলায় বাস্তবায়ন হয়েছে– সেটা তিনি এখনই জানলেন। খোঁজখবর নিয়ে অনিয়ম পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।