নগরীর হাজী মহসীন রোডে শনিবার সকালে ভ্যানে ফল বিক্রি করছিলেন সোলায়মান মোড়ল। ভোট কেমন হবে– জানতে চাইলে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ভোট কী সুষ্ঠু হবে? সকাল থেকে পরিস্থিতি ভালো থাকলে ভোট দিতে যাব। আর ঝামেলা হলে যাব না।

কথোপকথন শুনে পথচারী লিয়াকত শেখ এগিয়ে এসে বলেন, এবার মনে হয় ভোট ভালো হবে। কেউ বলছে, ভোট ভালো হবে, আবার কেউ বলছে ঝামেলা হতে পারে। আসলে বুঝতে পারছি না কী হবে? আমরা এখনও সংশয়ে আছি।

এর কিছু সময় পর সেখানে গণসংযোগে যান জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী শফিকুল ইসলাম মধু। তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আগের নির্বাচনগুলোতে মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেনি। এবারও সুষ্ঠু ভোট নিয়ে ভোটাররা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন।

নির্বাচনের প্রাক্কালে খুলনা বিভাগীয় কমিশনারকে বদলি করা হয়েছে। ফলে প্রশাসনের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তারা কি পারবে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে? তিনি বলেন, বিএনপি ভোট বর্জন করায় ভোটার উপস্থিতি কম হবে বলে তাঁর ধারণা।

বস্তুত খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা, তা নিয়ে এখনও বেশিরভাগ ভোটারের মধ্যে শঙ্কা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় ও খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ বারবার সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার করলেও আশ্বস্ত হতে পারছেন না বেশিরভাগ প্রার্থী ও সাধারণ ভোটার। অন্যদিকে নেতাকর্মীকে ভোট দিতে না যাওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছে বিএনপি। তবে মেয়র পদে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে মরিয়া।

ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী আব্দুল আউয়াল নগরীর বড়বাজারে গণসংযোগকালে সমকালকে বলেন, অতীতে অনেক নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ায় ভোটারদের মধ্যে উৎকণ্ঠা রয়ে গেছে। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে ক্ষমতাসীন দলেরই বেশি ক্ষতি হবে।

স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী শফিকুর রহমান মুশফিক বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা আছে। ভোটার উপস্থিতি কেমন হবে, তা নির্ভর করছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর আচার-আচরণের ওপর। সকাল থেকে তাঁরা ভোটকেন্দ্রের আশপাশে জটলা, মহড়া বা ভোটারদের বাধা দিলে উপস্থিতি কম হবে।

মরিয়া দুই দল

নির্বাচনের শেষ দিকে এসে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিএনপি। কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়া দলের ৯ নেতাকর্মীকে ইতোমধ্যে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারকাজে অংশ নেওয়ায় ২২ নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ৯ জুন রাতে নগরীর ৩১টি ওয়ার্ডে ২১ সদস্য করে গোপন মনিটরিং সেল গঠন করেছে বিএনপি। বিএনপি নেতাকর্মীরা কেউ ভোটকেন্দ্রে গেছেন কিনা, তা দেখবে এই সেল।

মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন জানান, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোট দেওয়ার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলে দলের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি দলীয় নেতাকর্মীকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তিনি জানান, খুলনাবাসীকে ভোটদান থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে ইতোমধ্যে মহানগর বিএনপি বিবৃতি দিয়েছে। ফলে দলের নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্রে যাবেন না বলেই তাঁর বিশ্বাস।

অন্যদিকে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী চার প্রার্থীকে ‘দুর্বল প্রার্থী’ হিসেবে বিবেচনা করছে আওয়ামী লীগ। ফলে ভোটে জেতার চেয়ে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোই ক্ষমতাসীন দলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এক মাসের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন দলের নেতাকর্মীরা। প্রচার-প্রচারণার শেষ দিন বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের ৩১টি ওয়ার্ড ও ২৮৯টি ভোটকেন্দ্রভিত্তিক কমিটির নেতাকর্মীরা ভোটারদের বাড়ি গিয়ে তাঁদের সুষ্ঠু ভোটের ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন।

মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমডিএ বাবুল রানা জানান, তাঁরা দলের নেতাকর্মীকে সকালেই ভোটকেন্দ্রে যেতে নির্দেশনা দিয়েছেন। ভোটাররা সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারবেন বলে দলের পক্ষ থেকে সাধারণ ভোটারদের আশ্বস্ত করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, বিএনপির প্রচেষ্টায় নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে না। ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে যাবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে।  শঙ্কা বা সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই।  

বিজিবি মোতায়েন

নগরীতে শনিবার ১১ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। দুপুর ও বিকালে তারা নগরীতে টহল দেয়।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মাসুদুর রহমান ভূঁইয়া জানান, নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রসহ নগরীর নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করবে ৪ হাজার ৫২০ জন পুলিশ ও ৩ হাজার ৪৬৮ জন আনসার। সোমবার নির্বাচনের দিন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। ভোটারদের উদ্বেগের কিছু নেই।

খুলনার জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন জানান, নির্বাচনের দিন ৪৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ১০ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন।

নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার আলাউদ্দিন জানান, পুলিশ, আনসার ও বিজিবি ছাড়াও র‍্যাবের ১৬টি টিমের ১২৮ জন সদস্য নির্বাচনের দিন নগরীতে টহল দেবে। নদীপথে টহল দেবে নৌ পুলিশ। এবারের নির্বাচনে দুটি বেসরকারি সংস্থার ২০ জন পর্যবেক্ষক ও নির্বাচন কমিশনের ১০ জন পর্যবেক্ষক থাকবেন।  

তিনি জানান, আজ রোববার বেলা ১১টায় বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স থেকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে নির্বাচনী সরঞ্জাম পাঠানো হবে। প্রস্তুত রয়েছে প্রায় ৩ হাজার ইভিএম মেশিন। এর আগে ৫ হাজার ৭৬০ জন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষে প্রায় ২ হাজার ৩০০টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। নির্বাচনের দিন আঞ্চলিক রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় ও নির্বাচন কমিশন থেকে মনিটরিং করা হবে। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হবে জেলা শিল্পকলা একাডেমি অডিটোরিয়ামে।

তিনি আরও জানান, প্রতিটি কেন্দ্রে নির্বাচন কমিশনের কারিগরি টিমের একজন সদস্য থাকবেন। ইভিএমে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান দেবেন তিনি।