- সারাদেশ
- ভোট জমিয়েছেন কাউন্সিলর প্রার্থীরা, শঙ্কাও তাঁদের নিয়ে
বরিশাল সিটি নির্বাচন
ভোট জমিয়েছেন কাউন্সিলর প্রার্থীরা, শঙ্কাও তাঁদের নিয়ে

নৌকার সমর্থনে মিছিলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। শনিবার বরিশাল নগরীতে - সমকাল
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন জমিয়ে তুলেছেন কাউন্সিলর প্রার্থীরা। তাঁদের জমজমাট প্রচারে দীর্ঘদিন পর উৎসবে রূপ নিয়েছে নির্বাচন। তবে ৩০টি ওয়ার্ডের অধিকাংশেই আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের একাধিক নেতা প্রার্থী হওয়ায় সংঘাতের আশঙ্কাও রয়েছে। গাজীপুরের নির্বাচনে আশা জেগেছে বরিশালেও সুষ্ঠু ভোট হবে। তাই সরকারি দলের কোনো না কোনো অংশের মদদে এ প্রার্থীরা সংঘাতে জড়াতে পারেন বলে শঙ্কাও বেড়েছে।
কাউন্সিলর প্রার্থী হয়ে দল থেকে বহিষ্কার হলেও ভোটের মাঠে রয়েছেন বিএনপি নেতারাও। অন্তত ১৬টি ওয়ার্ডে তাঁরা প্রার্থী। বিএনপির চার নেত্রী সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী। চারটি ওয়ার্ডে প্রার্থী হয়েছেন জামায়াত নেতারা।
এসব ওয়ার্ডে বিএনপির কেউ প্রার্থী হননি। তবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপির চেয়ে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধে সংঘাতের শঙ্কাই বেশি।
বরিশালে শাসক দল দু’ভাগে ভাগ হয়েছে সিটি নির্বাচনে। একদিকে রয়েছেন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহর অনুসারীরা। তাঁদের মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন এবার মনোনয়ন না পাওয়া বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর অনুগতরা।
২৪ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান মেয়র শরীফ মো. আনিছুর রহমান। তিনি ২০২১ সালে সাদিক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ করা’ ১০ কাউন্সিলের একজন। নিজেকে খোকন সেরনিয়াবাতের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন এই প্রার্থী। তাঁর বিরুদ্ধে নির্বাচন করছেন সাদিক আবদুল্লাহর অনুগত হিসেবে পরিচিত ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাফিন মাহমুদ তারেক। এ দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ভোটের প্রচারে সংঘর্ষও হয়েছে।
সাদিক আবদুল্লাহর পরিবার নির্বাচনে নৌকাকে হারাতে কাজ করছে বলে অভিযোগ করে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হয়েছেন আনিছুর রহমান। তিনি গতকাল সমকালকে বলেছেন, সাদিক অনুগতরা নৌকা এবং তাঁর ঠেলাগাড়ি প্রতীককে হারাতে কাজ করছেন। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে বলেছেন, সাদিক অনুগতরা ভোটে সন্ত্রাস করতে পারে। এ কারণে সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। আক্রান্ত হলে প্রতিহত করতে বাধ্য হবেন তিনি।
তবে এ অভিযোগ উড়িয়ে সাফিন সমকালকে বলেছেন, যারা সংঘাতের আশঙ্কার কথা বলছে, তারাই সংঘাত করতে পারে। নৌকাকে হারাতে ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখার পক্ষে কাজ করার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেছেন, ‘যিনি (আনিছুর) এ অভিযোগ করেছেন, তাঁর জামাতা, ভাইসহ আত্মীয়স্বজন হাতপাখার নেতা।’
আবুল খায়েরের অনুসারীদের বিরুদ্ধে সরকারি সংস্থা ব্যবহার করে প্রতিদ্বন্দ্বীদের চাপে রাখার অভিযোগ রয়েছে। ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাদিকপন্থি কাউন্সিলর প্রার্থী রাজীব হোসেন খান অভিযোগ করেছেন, কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে গিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের গ্রেপ্তারের হুমকি দিচ্ছে। এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। সাদিক মনোনয়ন না পাওয়ায় তাঁর অনুগতদের ওপর কিছুটা হলেও প্রভাব পড়েছে বলে স্বীকার করেছেন এই প্রার্থী।
আগামীকাল সোমবার বরিশাল সিটি নির্বাচনের ভোট। গতকাল শনিবার ছিল ভোটের প্রচারের শেষ দিন। বরিশালের ৯, ২৪, ২৩ এবং ২৬ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, তুমুল প্রচার চালাচ্ছেন কাউন্সিলর প্রার্থীরা। মেয়র প্রার্থীদের চেয়ে তাঁদের প্রচারই বেশি। কাউন্সিলর প্রার্থীদের মিছিল এবং মাইকের শব্দে কানে তালা লাগার উপক্রম হয়। তবে ভোটের প্রচারে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। প্রচারে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ছাড়াও ভ্রাম্যমাণ আদালতের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে।
গতকাল বরিশাল ঘুরে দেখা যায়, ভোটকেন্দ্রগুলোর আশপাশে উৎসবমুখর পরিবেশে ক্যাম্প তৈরি করা হচ্ছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে সাধারণত কাউন্সিলর প্রার্থীরা কেন্দ্রে ভোটার টানেন। জাতীয় রাজনীতির চেয়ে পাড়া-মহল্লার বিষয়, আত্মীয়তা প্রাধান্য পায় কাউন্সিলরের ভোটে। আবার আধিপত্যের বিস্তার নিয়ে গোষ্ঠীগত বিরোধও থাকে কাউন্সিলরের ভোটে। এ কারণে সংঘাতের শঙ্কাও থাকে।
বরিশাল মহানগর পুলিশ কমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেছেন, ভোটের দিনে বিশৃঙ্খলা করলে কঠোর হস্তে দমন করা হবে। প্রার্থীদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগে বরিশালের ১২৪টি কেন্দ্রের ১০৬টিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কেউ সংঘাত, সহিংসতার সুযোগ পাবে না।
বরিশালের ৩০টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হয়েছেন ১২৬ জন। ৭ নম্বর ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন সাদিকের অনুগত হিসেবে পরিচিত মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম খোকন। ১০টি সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডে প্রার্থী হয়েছেন ৪২ জন। আবুল খায়েরের অনুগত কাউন্সিলর প্রার্থীদের অভিযোগ, তাঁদের পাশাপাশি নৌকার মেয়র প্রার্থীকেও হারাতে প্রতি ওয়ার্ডে অনুসারীদের ভোটে নামিয়েছেন সাদিক। এতে ভোটের দিনে সংঘাত হতে পারে।
২০১৮ সালের ভোটে নৌকা প্রতীকে মেয়র পদে একতরফা জয় পান সাদিক। ওই নির্বাচনে ৩০টি সাধারণ ওয়ার্ডে তাঁর অনুসারীরা সবাই ঠেলাগাড়ি প্রতীকে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তখন বিএনপির পাঁচ নেতা সাধারণ ওয়ার্ডে জয় পান। একটিতে জেতেন জাতীয় পার্টির নেতা। তিনটি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে জেতেন বিএনপি নেত্রীরা। বাকিরা ছিলেন সাদিকের অনুসারী।
২০২১ সালে বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবনে মেয়র সমর্থকদের হামলার পর ১০ কাউন্সিলর পক্ষ বদল করেন। মেয়রের ঘোরবিরোধী হিসেবে পরিচিত এই কাউন্সিলররা এবারও প্রার্থী হয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছেন সাদিক। তাঁর অনুগত বাকি ১৪ কাউন্সিলরও প্রার্থী হয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আবুল খায়েরের অনুসারীরা।
বিদ্রোহী সেই ১০ কাউন্সিলরের নেতৃত্বে ছিলেন ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল হক বিপ্লব। তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন সাদিক অনুগত জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ওবায়দুল হক। ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে মেয়র অনুগত শফিকুল ইসলাম সুমন নির্বাচন করছেন। হুমায়ুন কবীরের সমর্থকদের ভাষ্য, পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এবার হয়তো অতীতের মতো ভোটে অনিয়ম হবে না। ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা থাকবে, তাই গোপন বুথে ঢুকে ইভিএমে কেউ ভোটারদের ভোট দিতে পারবে না। কিন্তু কেন্দ্রের বাইরে কেউ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলে সংঘাত হতে পারে।
প্রচারে পিছিয়ে নেই বিএনপি নেতারাও। তাঁদের পোস্টার-ব্যানারেও ছেয়ে গেছে বরিশাল শহর। ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নুরুল ইসলাম প্রার্থী হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়া জামায়াত নেতা মনিরুজ্জামান তালুকদার। তাঁর অভিযোগ, টাকা ছড়াচ্ছেন নুরুল ইসলাম।
মন্তব্য করুন