রোজার ঈদের মতো নির্বিঘ্ন হলো না কোরবানির ঈদযাত্রা। আগেই বৃষ্টি, মহাসড়কের পাশে গরুর হাট ও শহরমুখী পশুবাহী গাড়িতে ভোগান্তির শঙ্কা ছিল। মঙ্গলবার কলকারখানা ছুটির পর লাখো মানুষের ঢল সড়কে নামলে গাজীপুর হয়ে দুই মহাসড়কে তীব্র যানজট দেখা দেয়। এতে উত্তরবঙ্গ ও ময়মনসিংহ বিভাগের যাত্রীদের ভুগতে হয়।

সন্ধ্যার আগেই যানজটে স্থবির হয় উত্তরবঙ্গগামী মহাসড়কের কোনাবাড়ী থেকে চন্দ্রা মোড় পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার। চন্দ্রা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত থেমে থেমে ছিল যানজট। টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ছিল একই অবস্থা।

তবে ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট ছিল না। ভোগান্তি ছিল না ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে এবং পদ্মা সেতুতেও। নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন খুলনা ও বরিশাল বিভাগের যাত্রীরা। পদ্মা সেতুতে ২৪ ঘণ্টায় ৩১ হাজার ২৯৮টি গাড়ি পারাপার হয়েছে।

যানজটের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের পথে যানবাহন সংকটও যাত্রীদের ভুগিয়েছে। এ সুযোগে বাসে বাড়তি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বৃষ্টির কারণে ঢাকা ছাড়তে ভোগান্তিতে পড়েন হাজারো যাত্রী।

আগের কয়েক দিন কড়াকড়ি থাকলেও আজ সন্ধ্যার পর কমলাপুরে ভিড় বাড়ে। তবে টিকিট ছাড়া স্টেশনে প্রবেশে বাধা থাকায় অন্যান্য বছরের মতো এবারের ঈদযাত্রার ট্রেনে উপচে পড়া ভিড় হয়নি। ছাদে ভ্রমণ ঠেকাতে রোজার ঈদ থেকেই তৎপর রেলওয়ে। কিন্তু আজ কমলাপুর ছাড়ার পর উত্তরবঙ্গ এবং ময়মনসিংহ বিভাগগামী কয়েকটি ট্রেনের ছাদে ওঠেন যাত্রীরা।

দুপুরে রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনালে আগের দু’দিনের তুলনায় যাত্রীর চাপ বেশি দেখা যায়। বছরের অন্য সময় যাত্রী পেতে বাসগুলো কম ভাড়া নিলেও ঈদে ছাড় দিচ্ছে না। সরকার নির্ধারিত ভাড়াও মানা হচ্ছে না। ফলে ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আবার যাত্রী যেখানেই নামুক, বাসের সর্বশেষ গন্তব্যের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। ফলে বাড়তি ভাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছেন যাত্রীরা।

বেসরকারি চাকরিজীবী আবু তৈয়ব সমকালকে জানান, বৃষ্টির কারণে গাবতলী পর্যন্ত আসতেই ভোগান্তির শেষ নেই। মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ থেকে ৪০০ টাকা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় এসেছেন। যানজট বেশি এ অজুহাতে অটোরিকশা এর কমে আসতে রাজি হয়নি।

আবু তৈয়ব যাবেন রাজশাহী। তিনি ঢাকা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটের চাঁপাই ট্রাভেলসের টিকিট কাটেন। তাঁর কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয় ৮০০ টাকা। আবু তৈয়ব জানান, সাধারণ সময়ে তিনি ৩৫০ টাকায় যান। আজ বলা হয়, যেখানেই নামুন ঢাকা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটের পুরো ভাড়াই দিতে হবে।

‘চাঁপাই ট্রাভেলস’র মাস্টার মোজাম্মেল হক বলেছেন, নাটোর, রাজশাহীতে যাত্রী নামলেও পরের পথে যাত্রী পাওয়া যাবে না ঈদের সময়। এ জন্য শেষ গন্তব্যের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা-চাঁপাইনবাবগঞ্জের সরকার নির্ধারিত ভাড়া ৮১৫। ১৫ টাকা কম নেওয়া হচ্ছে।

গাবতলী টার্মিনালের পরই গুরুর হাট। তাই যানজটে আটকে ঢাকা ছাড়তেই ভোগান্তি হচ্ছে যাত্রীদের। তবে বেশি সমস্যা হচ্ছে ঢাকায় ফেরা বাসগুলোর। চন্দ্রা, সাভার, আমিনবাজার ও গাবতলীর যানজটে আটকে নির্দিষ্ট সময়ের দুই-তিন ঘণ্টা পর বাসগুলো ঢাকায় ফিরছে। এর ফলে যাত্রা করতেও বিলম্ব হচ্ছে।

কালিয়াকৈর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, আজ গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চলের বেশিরভাগ তৈরি পোশাক কারখানায় ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে। সকালে ফাঁকা থাকলেও বেলা ৩টার পর চন্দ্রা মোড়ে যানজট দেখা দেয়। সন্ধ্যায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। রাত ৯টার দিকে কোনাবাড়ী থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার পথে যানজটে গাড়ির নিশ্চল সারি ছিল।

রাজশাহীগামী যাত্রী জুলেখা বেগম, নুসরাত জাহান, সালেহা খাতুন, তানভীর আহমেদ জানান, ৩ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষায় রয়েছেন। বাস পাচ্ছেন না। মালতি পরিবহনের চালক ফারুক হোসেন জানান, ঢাকা থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত সহজেই এসেছেন। এর পর যানজটে পড়েন।

নাওজোড় হাইওয়ে থানার ওসি আতিকুর রহমান জানান, শিল্প কারখানার শ্রমিকরা বাড়ি ফিরতে শত শত বাস রিজার্ভ করেছেন। সেগুলো বিকেলে একসঙ্গে সড়কে নামায় যানজট দেখা দেয়।

গাজীপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার পথে মঙ্গলবার বিকেলের পর যানজট হয়। রাত ৯টার দিকে তা আরও বাড়ে। পুরো পথে ছিল গাড়ির স্থবির সারি। তিন থেকে চার ঘণ্টা লাগছে এ ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে।

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপাড় থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার পথে দিনভর ধীরে ধীরে গাড়ি চলেছে। সন্ধ্যার পর যানজট হয়।

এলেঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (ওসি) জাহিদ হাসান বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতুতে গাড়ির চাপ রয়েছে। যানবাহন ধীরগতিতে চলাচল করছে। যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ নিরলস কাজ করছে।

সোমবার রাত ২টার দিকে বঙ্গবন্ধু সেতুতে দুর্ঘটনা ও বাস বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে রাত ৩টার পর ১০  থেকে ১২ মিনিট, ৪টার পর প্রায় ১ ঘণ্টা ও সাড়ে ৫টা থেকে পৌনে ৬টা পর্যন্ত টোল আদায় বন্ধ ছিল। এতে উত্তরবঙ্গগামী পরিবহনের দীর্ঘ লাইন হয়। আর সকাল থেকে টানা বৃষ্টি ভোগান্তি আরও বাড়ায়।

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমেপাড়ে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে যানজট না থাকলেও ঢাকাগামী লেনে দিনভরই ধীরগতি ছিল। শত শত যানবাহন বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে পূর্বপাড়ে ভুয়াপুর দিয়ে যেতে ট্রেন সিগন্যালে আটকা পড়ে।

বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম থানার ওসি রওশন ইয়াজদানী জানান, প্রতিদিন ৪৪টি ট্রেন সেতু পার হয়। এ কারণে রেলগেট বন্ধ রাখতে হয়। ফলে যানবাহনের লম্বা লাইন তৈরি হয়।

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গাড়ির চাপ বেড়েছে। ফেরি পারাপারের জন্য বাসগুলোকে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা ঘাটে অপেক্ষা করতে হয়। যাত্রীরা হেঁটে ঘাটে এসে লঞ্চে নদী পার হন। বৃষ্টিতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন তাঁরা।

মানিকগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ গোলাম আজাদ খান জানান, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক এবং মানিকগঞ্জ-হেমায়েতপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের যানজট নিরসনে তিনি নিজে সড়কে কাজ করছেন।